অস্তিত্ব সংকটে জনগুরুত্বপূর্ণ নদী অদের খাল

দখলে ও দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জনগুরুত্বপূর্ণ নদী অদের খাল। নদীর তীরে দখল করে দোকানপাট ও আবাসিক ঘর নির্মাণসহ অনুমোদন ছাড়াই ব্রিজ নির্মাণ এবং যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার ভাগারে সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর গতিপথ। এসব কারণে বর্ষায় নৌ-রুট বন্ধ এবং সুস্ক মৌসুমে ব্যহত হচ্ছে সেচ সুবিধা। এতে সেচ সংকটে পাঁচ উপজেলার অন্ততঃ ৬০গ্রামের কৃষক।

নদীটির বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করেন নদী ও প্রকৃতি সুরক্ষা সামাজিক আন্দোলন ‘তরী বাংলাদেশ’ এর একটি প্রতিনিধিদল। তারা নবীনগরের বাংগরা বাজার, গাজীরহাট, জাঙ্গাল, গাজীপুর ও রাজাবাড়ীসহ নদীটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং নদী তীরবর্তী মানুষের সাথে কথা বলেন।

‘তরী বাংলাদেশ’এর আহবায়ক শামীম আহমেদ এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন তরী বাংলাদেশ-এর আহবায়ক কমিটি সদস্য, খালেদা মুন্নী ও সোহেল রানা ভূঁইয়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জহির রায়হান, সাংবাদিক ও তরীর সদস্য জামাল হোসেন পান্না প্রমুখ।

এ ব্যাপারে ‘তরী বাংলাদেশ’এর আহবায়ক শামীম আহমেদ বলেন, নবীনগরের বাংগরা বাজারে সওজ’র সড়কের পাশে খালের পাড়ে সরকারী জায়গায় দোকানপাট ও পাকা স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, এমন সংবাদে আমার সরেজমিনে দেখতে আসি। এসময় বাজারের এসব অবৈধ স্থাপনা দেখতে গিয়ে অদের খালের বেহাল অবস্থা নজরে আসে। শুরুতেই আমরা বাংগরা ও গাজীর হাটের মধ্যবর্তী অদের খালের উপর অবস্থিত সওজ’র ব্রীজের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা এবং ব্রীজের নীচে ময়লার ভাগার দেখতে পাই। যার ফলে অদের খাল সংকুচিত হয়ে রীতিমতো নদীর গতিপথ মোরাত্মক ভাবে ব্যহত হচ্ছে! পরে আমরা অদের খালটির বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শন করি। এসময় যা দেখলাম তাতে বিস্মিত হওয়ার মতো! অদের খালের রাজাবাড়ী-আশ্রাফপুর এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরকারী কোনো অনুমোদন ছাড়াই একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে বর্ষায় নৌরুট বন্ধেরও অভিযোগ পেয়েছি স্থানীয়দের কাছ থেকে!

তরী বাংলাদেশ-এর আহবায়ক কমিটি সদস্য, খালেদা মুন্নী ও সোহেল রানা ভূঁইয়া এবং সাংবাদিক জাহির রায়হান বলেন, এখানে এসে দেখতে পেলাম যে, অদের খালের উপর সরকারী অনুমোদন বিহীন একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম একটি স্বার্থান্বেষী মহল জমিজমার মূল্য বৃদ্ধির জন্যেই ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে নৌরুট বন্ধের পাশাপাশি নাব্যতা সংকটে নদীটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে।

দখল ও দূষণে ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার পাঁচ উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ নদী ‘অদের খাল’। নদীর রাজাবাড়ী অংশে নকশা বহির্ভূত অনুমোদন বিহীন ব্রিজ নির্মাণের ফলে বর্ষায় নৌ-রুট বন্ধ আর সুস্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকটে সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অন্ততঃ ৬০ থেকে ৭০গ্রামের কৃষক।

এব্যপারে ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, অদের খাল হলো কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচ উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একটি জনগুরুত্বপূর্ণ নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীটি সালদা নদী নামে কসবা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবীনগরের আদর্শগ্রাম, মুরদনগরের কালিগঞ্জ এবং কসবার শিমরাইল এই ত্রিমোহনায় এসে বুড়ি নদীর সাথে মিলিত হয়। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে বয়ে যাওয়া স্রোতধারার নাম অদের খাল। অদের খাল নামে নদীর স্রোতধারা মিলিত হয়েছে মেঘনায়। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে অদের খাল মিলিত হয়েছে মেঘনায়। যুগযুগ ধরে নদীটি একপাশে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর এবং অপর পাশে কুমিল্লার মুরাদনগর ও হোমনা উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

তরীর আহবায়ক শামীম আহমেদ বলেন, পরিদর্শন কালে আমরা স্থানীয়দের সাথে কথা বলি। স্থানীয় আবদুল হক দারোগার ছেলে সাদেকুর রহমান, শাহাদাৎ হোসেন রুমি, নুরুল হক ভূইয়ার ছেলে ইয়ার হোসেন, আবদুর রউফ এর ছেলে রাশেদ মিয়া, মিজানুর রহমানের ছেলে জাকির হোসেন বলেন, একসময় এই এলাকার একমাত্র নৌ-রুট অদের খাল দিয়ে এই এলাকার প্রসিদ্ধ হাট-বাজারের পণ্যসামগ্রী পরিবহণে বেশ গুরুত্ব বহন করলেও সময়ের ব্যবধানের এটি পরিণত হয়েছে মরা নদীতে! রাজাবাড়ী অংশে অবৈধ ভাবে একটি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। যার ফলে ২০২২ সালের পর থেকে এই নদীতে পূর্ণবর্ষায় নৌ চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

শামীম আহমেদ বলেন, নদী প্রসঙ্গে আমাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লূত হন নদী তীরের বাসিন্দা, রাজাবাড়ী গ্রামের প্রয়াত আবদুল খালেকের স্ত্রী শতবর্ষী জানুর মা। তিনি আমাদের বলেন, ‘তিনি ৭০-৮০ বছর ধরে দেখে আসছেন এই নদীতে বড়বড় নৌক চলতো, মানুষ গোসল করতো, জেলেরা মাছ ধরতো। এখন আর কিছুই নেই।’ নিজের বাড়ীর পাশে নির্মত অবৈধ ব্রিজটি দেখিয়ে তিনি বলেন, এই বিরিজের কারনে অহন আর নাও চলেনা (এখন নৌকা চলেনা)।

শামীম আহমেদ বলেন, নদীটির বাংগরা বাজার ও গাজীর হাট অংশে বাজারের ময়লা আবর্জনা ফেলে প্রায় বন্ধ করে ফেলা হয়েছে নদীর গতিপথ। এছাড়াও অদের খাল ও এর শাখা খালের দুই পাশে দোকান ঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এমন দখল ও দূষণের চিত্র রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া নদীর রাজাবাড়ি অংশে নকশা বহির্ভূত ভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে বেইলী ব্রিজ নির্মাণের ফলে বর্ষায় বন্ধ হয়ে গেছে এই অঞ্চলের একমাত্র নৌ-রুট।

নদীটির বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করে নদী ও প্রকৃতি সুরক্ষা সামাজিক আন্দোলন ‘তরী বাংলাদেশ’ এর একটি প্রতিনিধিদলটি নদী খনন, অবৈধ ব্রিজ অপসারণ ও অবৈধ দখল মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন নদীতীরে মানববন্ধন করেন।

দখল দূষণের শিকার হয়ে এবং অবৈধ স্থাপনার কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়া অদের খাল অচীরেই দখল মুক্ত হয়ে আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এমনটাই প্রত্যাশা এই এলাকার মানুষের।

Share