পড়ালেখায় অমনোযোগী ছেলেকে মনোযোগী করতে মা তাহমিনা বিনতে হক প্রথম শ্রেণি থেকে ছেলে তওহীদুল ইসলামের পিছু লাগেন। পড়ার টেবিলে ছেলের পাশে বসা, বই-খাতা গুছিয়ে দেওয়া, স্কুলে যাওয়া-আসায় সঙ্গে থাকাসহ সবকিছু করতে হয়েছে ছেলের মাকে। এসব করতে গিয়ে নীরবে তিনি পড়ালেখায় কখন যে মনোযোগী হয়ে ওঠেন বুঝতেই পারেননি।
আর তাই কাউকে না বলে চুপিসারে নবম শ্রেণিতে নিজের নাম নিবন্ধন করেন তাহমিনা বিনতে হক। পরীক্ষার আগে ফরম পূরণও করেন নীরবে। তবে পরীক্ষার সময় বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পিছু না হটে ছেলের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেন মা। অপেক্ষা করতে থাকেন পরীক্ষার ফলের জন্য। গত রোববার সেই অপেক্ষার অবসান হয়। ছেলের চেয়ে তুলনামূলক ভালো ফল করে ভয় কাটিয়ে উঠেছেন মা তাহমিনা হক।
মঙ্গলবার দুপুরে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার আনন্দ নগর গ্রামের বাড়িতে মা-ছেলের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাহমিনা বিনতে হক বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখার সময় ব্যবসায়ী আলমগীর কবীরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁদের ঘরে আসে ছেলে তওহীদুল ইসলাম ও মেয়ে তওফিকা ইসলাম। ছোটবেলা থেকে ছেলে পড়ালেখায় অমনোযোগী ছিল। ব্যবসায় ব্যস্ত থাকায় ওর বাবা ওকে সময় দিতে পারতেন না। তাই ছেলেকে পড়ালেখায় মনোযোগী করতে নিজেই ছেলের সঙ্গী হয়ে যান। সারাক্ষণ ছেলের সঙ্গে সময় কাটে। একসময় তিনি ভাবতে শুরু করেন, শুধু শুধু বসে থেকে কী হবে? নিজেও পড়ালেখা করবেন। কিন্তু ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চাননি। সাহস করে জোনাইল আইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভোকেশনাল শাখায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে যান। আর ছেলে স্থানীয় দ্বারিকুশি প্রতাপপুর উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে নিবন্ধন করে।
সবকিছু চলে গোপনে। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগ মুহূর্তে বিষয়টি সবার নজরে আসে। ততক্ষণে পরীক্ষার অংশ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর তিনি। স্বামীও সাহস জুগিয়েছেন তাঁকে। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, তিনি পেয়েছেন গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ) ৪.২৩। আর তাঁর ছেলে পেয়েছে জিপিএ ৪.০৬। ছেলেকে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য পিছু লেগে নিজেই আরও বেশি ভালো ফল করে বসেছেন এই মা। জিপিএ-৫ না পাওয়ার আক্ষেপ থাকলেও ৩৪ বছর বয়সে এসে এমন ফল করে বেশ খুশি তাহমিনা।
ছেলে তওহীদুল বলে, মা তার সঙ্গে সঙ্গে বই-খাতা নিয়েই থাকতেন। তবে পড়ালেখা ছাড়াও মা সংসার দেখাশোনা, গরুপালন, লিচুবাগানের খোঁজখবর নেওয়ার কাজও করেছেন।
তাহমিনার স্বামী আলমগীর কবীর বলেন, পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামের মেয়ে তাঁর স্ত্রী। খুব অল্প বয়সে তিনি সংসার শুরু করেছেন। কখনই পড়ালেখা শুরুর কথা বলেননি। তিনিও আগ্রহ দেখাননি। ছেলে পড়ালেখায় খারাপ করায় তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। এ কারণে তিনি স্কুলে না গেলেও পড়ালেখার মধ্যেই থাকতেন। সর্বোপরি তাঁর এমন ফলে তিনি ভীষণ আনন্দিত।
তাহমিনা চাইলে ছেলের সঙ্গে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবেন, এতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান আলমগীর কবীর।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur