ফিচার

‘মরার পর মাটিতো দিবে,অভিশাপ দিবো কেন?’

রাজধানীর দয়াগঞ্জে অবস্থিত ইবনে সিনা হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম, তো বেশ কয়েকজনকে অফার করলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার জন্য, কিন্তু কাছে হওয়াতে কেউই রাজি হলো না।

হঠাৎ একটা রিকশার দিকে নজর গেল, দেখলাম ড্রাইভার নাই, একজন অতি বৃদ্ধলোক রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, উনার কাছে প্রশ্ন করলাম, চাচা এই রিকশার ড্রাইভার কোথায় বলতে পারেন?

উনি অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মত আদো আদো কন্ঠে বললেন, ‘বাবা আমিই ড্রাইভার (!!) কোথায় যাবেন বলুন নামিয়ে দিয়ে আসি, (জায়গার নাম বলতেই) তবে হ্যা, ভাড়া ৫ টাকা বেশি দিতে হবে, আর জোরে চালাতে ধমক কিন্তু দিতে পারবেন না’

আমি উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, বৃদ্ধের চেহারা দেখে আর মুখের কথা শুনে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসলো।

শুধু এতটুকু বললাম, আচ্ছা দিবো চলুন, আপনি যেভাবে চালাতে পারেন সেভাবেই চালান কিছু বলবো না, বৃদ্ধলোক রিকশা টান দিলেন, বুঝলাম বয়সের ভারে লোকটি কুঁজো হয়ে গেছে।

উনি পাঁচ মিনিটের রাস্তা প্রায় ২০ মিনিট ধরে আসলেন, পথে অন্য রিকশাওয়ালারা বৃদ্ধকে বিভিন্ন ভাষায় টিজ করতে লাগলো, কেও দাদা বলে কেও বা আবার বউ কয়টা বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, আমি বেশ কয়েকজনকে ধমকও দিলাম। লক্ষ করলাম পথিমধ্যে অনেকেই লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।

যাই হওক, উনি আমার গন্তব্যে আসলেন, আমি রিকশা থেকে নেমে উনাকে পাঁচ শ টাকা দিয়ে বললাম চাচা এই নেন ভাড়া, উনি বললেন বাবা আমার কাছে ভাংতি হবে না, আমি বললাম, আপনি পুরাটা রেখে দেন, বৃদ্ধের জবাব, আমি ভিক্ষা করি না, কাজ করি আপনি নির্দিষ্ট মজুরি দেন, আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, আমি আপনার রিকশা ভাড়া বাবদ পাঁচশত টাকা দিলাম রাখেন, বৃদ্ধলোক নাচোড় বান্দা কিছুতেই নিবে না!

উনাকে বললাম, চাচা, আমি আপনার ছেলের মত নেন সমসস্যা নাই, উনি প্রশ্ন করলেন, তোমার বাবা মা বেঁচে আছে? বললাম, আলহামদুলিল্লাহ্ আমার আব্বা আম্মা দুইজনই পরম মমতায় এখনো আগলে রেখেছেন আমাকে।

বৃদ্ধের বয়সসহ নাম জানতে চাইলাম, বললেন নাম আদম আলী, বয়স ৮০ এর উপরে, তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না বয়স অবশ্যই ১০০ এর বেশি হবে।

উনাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার ছেলে মেয়ে আছে? বৃদ্ধলোক উত্তর দিলেন, আমার চার ছেলে ও এক মেয়ে আছে শুনে অবাক হলাম, জানতে চাইলাম সন্তানদের ব্যাপারে।

বৃদ্ধলোক বলতে লাগলেন, ‘সবাই বিবাহিত, ছেলেদের ঘরে একেকজনের ৩/৪ করে সন্তান, সবাই ভাল উপার্জন করে, স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে, মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামি সি এন জি (অটু স্কুটার) চালক, আমি আর বুড়ি আলাদা থাকি, পাকিস্তান পিরিয়ডে ২৫ টাকা পণ দিয়ে বিয়ে করেছি আল্লাহর রহমতে আজো এক সাথে আছি’।

জানতে চাইলাম, আপনার ছেলেরা আপনার বরণ-পোষণ করে না কেন? তাদের কাছে যান না আপনি? বৃদ্ধের এক উত্তর, ‘তাদের সংসারে আমাদের কোন ঠাই নাই, আমাদের আল্লাহ্ আছেন’।

কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, সন্তানরা আপনাদের ভালবাসে না, আপনি তাদের অভিশাপ দেন না? বৃদ্ধ আমার প্রতি রেগে গেলেন, ‘বললেন অভিশাপ দিবো কেন? আমি মরার পর কবরে মাটিতো দিবে’।

নিজেকে আর ধরে রাখা হলো না আমার, বৃদ্ধ বুঝতে পেরে নিজের হাতে চোখের জল মুছে দিলেন, বললেন, ‘বাবা তোমার পিতা মাতা ধন্য, তোমাকে জন্ম দিয়ে, তোমার টাকাটা আমি নিবো’

একটু ভাল লাগলো আমার, উনাকে টাকাটা দিয়ে আমার কার্ড দিয়ে বললাম, আপনার যদি কোনো প্রয়োজন পড়ে এই নম্বরে তিনটা মিডস্ কল দিবেন, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো আপনার জন্য, তারপর উনার সাথে ছবি তুলতে চাইলাম, উনি মুখে থাকা মাত্র দুটি দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি দিলেন, সাথে আমিও।

তো আমাদের দুজনের কৃত্তিকলাপ আশপাশের অনেকেই দেখছিলেন, তাদের মধ্যে আমার এক আত্মীয় বৃদ্ধকে ১০০ টাকা দিলেন, প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে আমার কথায় নিলেন।

একটি রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের এই আবেগী দৃশ্যগুলো চলছিল, আর রেস্তোরাঁর মালিক ভিতরে বসে বসে সব লক্ষ করছিলেন, আমি বৃদ্ধলোকটিকে বিদায় দিবো এমন সময় তিনি আসলেন, এবং আমাদের দুইজনকেই পছন্দমত ফ্রি খাওয়ার অনুরোধ করলেন, আমি না খেলেও ১০০ বছরের বেশি বয়সী বৃদ্ধ আদম আলী মাছের বারকিউ দিয়ে খুব তৃপ্তি সহকারে নান রুটি খেলেন।

বন্ধুগণ, এই স্ট্যাটাসটি আমি আমার পাবলিসিটির জন্য করিনি, করেছি শুধুমাত্র ঐ সব বিবেকহীন পশুদের জন্য যারা ১০০ এর বেশি বয়সী পিতাকে রাস্তায় ছেড়ে দেয় খাবার খুঁজতে এবং আমার মত যুবকরা যেন এ সমস্ত অসহায়দের অসম্মানিত না করেন।

সত্যিই একটি ভাল কাজ অনেকগুলো ভাল কাজের জন্ম দেয়।

Share