জাতীয়

অভিনব কৌশলে বার বার ব্লগার খুন

নিউজ ডেস্ক :

কিছুদিন পরপর অভিন্ন কৌশলে খুন করা হচ্ছে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট বা ব্লগারদের। চলতি বছরেই চারজন ব্লগারকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

হত্যাকারীদের কৌশলগুলো হচ্ছে— একাধিক মানুষ কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া, হত্যাকাণ্ডে ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার, হত্যার জন্য নির্জন জায়গা বা নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নেওয়া। এ ছাড়া হত্যা মিশনের সময় ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত কোপের জন্য টার্গেট করা হয়।

সর্বশেষ শুক্রবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ের গোড়ানে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)।

দুপুরে জুমার নামাজের সময় যখন বেশিরভাগ মুসল্লি মসজিদে তখন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসায় ভাড়া নেওয়ার কথা বলে ঢুকে পড়েন দুর্বৃত্তরা। নিলয় নীল নামে বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুকে তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি খিলগাঁও গোড়ানের ১৬৭ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার বাসায় স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে থাকতেন। তিন বছর হয়েছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে মাস্টার্স পাস করেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় জানান, আগে যেভাবে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট বা ব্লগারদের খুন করা হয়েছে, নিলয় হত্যাকাণ্ডে তার ধরনে মিল রয়েছে। তাকেও একইভাবে মুখের নিম্নাংশ, গলা ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে দুর্বৃত্তরা।

তিনি আরও জানান, প্রতিবার দুই বা ততোধিক দুর্বৃত্ত হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। তারা অস্ত্র হিসেবে রামদা বা চাপাতি ব্যবহার করে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। জুমার নামাজের সময় যখন আশপাশের বাসার পুরুষরা নামাজে গেছেন, চিৎকার করলে সহজে কেউ বের হবেন না, ঠিক সেই সময়টিকেই অপরাধীরা বেছে নেয়।

এর আগে, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, মুক্তমনা ব্লগের আরেক ব্লগার, লেখক ও ব্যাংকার অনন্ত বিজয় দাস, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট আহমেদ রাজিব হায়দার শোভনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এ বছরের হত্যাকাণ্ডে শুধু ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যায় অংশ নেওয়া দুজন ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

গত ১২ মে সকাল ৯টায় সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় অনন্ত বিজয় দাস নামে এক ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত এ ব্লগার রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার বেগুনবাড়ি এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার সময় আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার পথে পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জার্মানিতে তার মৃত্যু হয়।

অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট আহমেদ রাজিব হায়দার শোভন হত্যাকাণ্ডে ৭ আসামিকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এ ঘটনার একজন আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। জনসাধারণের সহায়তায় অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া দুজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকারীরা অনেক তথ্যই স্বীকার করেছে। গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, এরা মনে করে মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারীদের হত্যা করতে হবে। অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট যাদের এ পর্যন্ত খুন করা হয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে এরা সকলেই মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারী। গুলি করে হত্যা করলে সওয়াব কম। তাই তরবারি, চাপাতি, রামদা অথবা চাইনিজ কুড়াল দিয়েই কুপিয়ে হত্যা করতে হবে। এর মধ্যে গলায় অথবা ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা করলে সওয়াব আরো বেশি। তাই তারা গলা অথবা ঘাড় টার্গেট করে সব সময় কোপ দেয়।

ডিএমপি’র গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘টার্গেট অনুসারে হত্যাকারীরা নীরবে এ সকল মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করে চলেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। তাই হত্যাকারীদের সঠিকভাবে শনাক্ত করতে এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে একটি বিশেষ ইউনিটের প্রয়োজন। আশা করছি বিশেষ ইউনিট শিগগিরই গঠন করা হবে।’

Share