ফিচার

আইয়ামে জাহেলিয়াতের রাজনীতি !

আইয়ামে জাহেলিয়াত বলতে কী বুঝায় অথবা কোন পরিস্থিতিতে শব্দটি সার্থক হয়, তা বাংলাদেশের মানুষকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। কারণ, শতকরা নব্বইজন মুসলমানের দেশে আরবি শব্দ আইয়ামে জাহেলিয়াত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও সুপরিচিত। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম এবং কুরআন-হাদিস-ইজমা-কিয়াসকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা চালুর আগে জাজিরাতুল আরবে যে ভয়ঙ্কর, নোংরা এবং অমানবিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজমান ছিল সেগুলোর নিকৃষ্টতা বুঝানোর জন্য আইয়ামে জাহেলিয়াত শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

ওই আমলের বেশির ভাগ আরব অধিবাসীর মন-মানসিকতা, চরিত্র, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা ও রাজনীতি ছিল যুদ্ধকেন্দ্রিক। তাদের বিয়েশাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভোগ-বিনোদন, যৌনতাড়না, প্রেম-বিরহ, শিল্প-সাহিত্য-কবিতা ইত্যাদি সব কিছুর মূলেই ছিল যুদ্ধের তাড়না।

যুদ্ধজয়ের প্রবল তাড়না অথবা পরাজিত হওয়ার নিদারুণ আতঙ্ককে ঘিরেই তাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কিছু রচিত হতো। আধুনিক যুগের যুদ্ধ অথবা মধ্যযুগ কিংবা প্রাচীনকালের যুদ্ধের মতো আইয়ামে জাহেলিয়ার যুদ্ধ পরিচালিত হতো না। অমানবিকতার সর্বনিকৃষ্ট এক জটিল রসায়নে প্রভাবিত হয়ে আরবরা জাহেলিয়াতের যুগে কেন এবং কিভাবে যুদ্ধ করত তা নিয়েই আজকের নিবন্ধে সাধ্যমতো আলোচনার চেষ্টা করব।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুদ্ধের ধরন-ধারণ বুঝতে হলে আমাদের শব্দ দু’টির মর্মার্থ বুঝতে হবে। আইয়াম শব্দের অর্থ হলো যুগ, সময় বা কাল। অন্য দিকে, জাহেলিয়াত অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার, নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদি বুঝালেও সে যুগের মানুষকে কোনো অবস্থায়ই বোকাসোকা অথবা নির্বোধ বলা যাবে না। ইসলাম আবির্ভাবের আগে মোটামুটি এক শ’ থেকে দেড় শ’ বছর সময়কালকে অনেকে জাহেলিয়াতের যুগ বলে থাকেন। যখন আসলে তামাম দুনিয়াতেই জাহেলিয়াত চলছিল। ইউরোপের প্রভাবশালী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল এবং বর্বর ভাণ্ডালদের আক্রমণে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছিল আরব দেশের চেয়েও মর্মান্তিক এক জাহেলিয়াত যুগের। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অধীন রাজ্যগুলো বিশেষ করে সিরিয়া, মিসর, জেরুসালেম, লেবানন প্রভৃতি এলাকায় চলছিল মারাত্মক গৃহযুদ্ধ। অন্য দিকে তাদের চিরশত্রু পারস্য সাম্রাজ্যে শুরু হয়েছিল বিশৃঙ্খলা। সাসানিদ সম্রাট প্রথম খসরুর মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্যে যে বিভীষিকা আরম্ভ হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একইভাবে ভারতবর্ষ এবং চীনেও চলছিল মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কট, হানাহানি, গৃহযুদ্ধ এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

আরব ভূমি নিয়ন্ত্রণকারী পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের প্রভাব ছাড়াও ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য চীন, ভারত ও উত্তর আফ্রিকার ওপর আরবদের নির্ভর করতে হতো। ফলে ওইসব অঞ্চলে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিলে মূল জাজিরাতুল আরব যথা হেজাজ, নজদ ও নুফুছেও শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, যার আরবি নাম আইয়ামে জাহেলিয়াত। বিশ্ববিখ্যাত বাণিজ্যিক পথ সিল্ক রুটের আরব অংশটি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আরবের সাথে সিরিয়া, পারস্য, ফিলিস্তিন, ইয়েমেনের সানা ও হাদ্রামউত, জর্ডানের আকাবা, ইথিওপিয়া (আবিসিনিয়া), মাগারব, লিবিয়া, মিসর প্রভৃতি অঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্য ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। ফলে আরববাসী তাদের অনাদিকালের পেশা পরিবর্তন করে জাহেলি যুগের চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাস, টাউট-বাটপার ও প্রতারকের পেশায় নাম লেখায়। এভাবে কয়েক যুগ চলার পর তারা ওসব কাজে ততটাই দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে পড়ে যার কারণে তাদের দুর্নাম সমকালীন দুনিয়ার অসভ্যতামিতে এক অন্ধকারময় অধ্যায় সৃষ্টি করে এবং আইয়ামে জাহেলিয়াতরূপে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের পর বহু শতাব্দী পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেই যুগের দুর্বৃত্ত এবং তাদের দুর্বৃত্তপনার ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীব্যাপী যুগ-যুগান্তরে নানাধর্মী গবেষণা চলে আসছে। তারা কি স্বেচ্ছায় জাহেল হয়েছিল, নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের অধিক জাহেল প্রমাণ করতে গিয়ে একসময় সত্যিকার জাহেলে পরিণত হয়! অথবা প্রত্যেক দেশ-জাতিরই কলঙ্কময় কতগুলো ইতিহাস রয়েছে, যা কালের বিবর্তনে তাদের ভালো কর্মে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াত কোনো মানুষ ভুলতে পারছে না। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী আবার ইসলামের অভ্যুদ্বয় এবং জাহেলিয়াতের ওপর ইসলামী হুকুমাতের বিস্ময়কর সফলতার কারণে উদাহরণ হিসেবে সেই সময়কার কর্মকাণ্ড সামনে চলে আসাকেও দায়ী করেছেন। যা হোক, আমরা আজকের আলোচনায় অতসব তত্ত্বকথা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিবৃতি না দিয়ে শুধু আইয়ামে জাহেলিয়াতের রাজনীতি নিয়েই কথা বলার চেষ্টা করব।

আমার মতে, জাহেলিয়াতের যুগে পুরো দেশকাল দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে একদল ছিল অত্যাচারী এবং অপর দলটি ছিল অত্যাচারিত বা মজলুম। অত্যাচারীদের মধ্যে বিভিন্ন দল, উপদল, শ্রেণী, বংশ ইত্যাদি থাকলেও মজলুমের কোনো দল ছিল না। সে যুগের অত্যাচারীরা ছিল সব কুকর্মের হোতা। তারা তাদের কুকর্মের ক্ষেত্র হিসেবে যেমন মজলুমদের ব্যবহার করত তেমনি নিজেদের কুকর্মের সাথী হিসেবে মাঝে মধ্যে সাহায্যকারীরূপে মজলুম শ্রেণীটি ব্যবহার করত। তাদের বুদ্ধি-শুদ্ধি ছিল ধুরন্ধরিতে ভরপুর। জুলুম অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ, জেনা-ব্যভিচার ইত্যাদি কুকর্ম কত নিকৃষ্টভাবে করা যায়, তা নিয়ে তারা রীতিমতো গবেষণা করত এবং পরস্পরের সাথে দম্ভসহকারে প্রতিযোগিতা করে বেড়াত। যে ব্যক্তি বা গোত্র এসব কুকর্মে সিদ্ধি লাভ করত, সে বা তারাই সমাজের নেতা বা নেতৃস্থানীয় বলে বিবেচিত হতো।

জাহেলি যুগের অত্যাচারের প্রধান হাতিয়ার ছিল যুদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য স্থান ও কালের যুদ্ধ থেকে জাহেলি যুগের যুদ্ধের প্রধান পার্থক্য ছিল- সাধারণত একটি উপলক্ষ, ঘটনার কারণ থেকে যুদ্ধের উৎপত্তি হয়; কিন্তু জাহেলরা প্রথমে যুদ্ধ আরম্ভ করে তারপর উপলক্ষ, ঘটনা ও কারণ সৃষ্টি করত। অর্থাৎ তারা কোনো কারণ ছাড়াই একজন অপরজনের সাথে অথবা এক গোত্র অপর গোত্রের সাথে কিংবা একটি অঞ্চল অপর অঞ্চলের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিত। তারপর সেই যুদ্ধকে উপলক্ষ করে তারা যুগের পর যুগ ধরে কলহবিবাদ, মারামারি, খুনোখুনি এবং শত্রুতা করে বসত। তাদের অন্তর থাকত সব সময় ঘৃণা ও ক্রোধে পরিপূর্ণ। তাদের বিবেক, বোধ, বিচারশক্তি ও বিবেচনাশক্তি উল্টো হয়ে গিয়েছিল। তারা সর্বদা নিজেদের কর্মকে সঠিক এবং প্রতিপক্ষের কর্মকে বেঠিক মনে করত। তারা শত্রুপক্ষকে মানুষ তো দূরের কথা পশুর মর্যাদা দিতেও নারাজ ছিল। তারা বিষধর সাপ, কীটপতঙ্গকে যেভাবে নির্মূল করত তার চেয়েও নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে শত্রু নির্মূলে অব্যাহত চেষ্টা করত। তারা নিজেদের পরিত্যক্ত মল-মূত্রকে যেভাবে এড়িয়ে চলত ঠিক একইভাবে শত্রুদের সংস্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখত।

জাহেলি যুগের মানুষ সারাক্ষণ যুদ্ধ বাধানোর জন্য উদগ্রীব থাকত। তারা যুদ্ধের জন্য নানা ছল-ছুতো খুঁজে বেড়াত। যখন দেখত কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তখন তারা যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার জন্য কবিদের ভাড়া করে আনত। দেশ-বিদেশের কবিরা জাজিরাতুল আরবের জাহেলিয়াতকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করতেন। তারা প্রতিপক্ষকে উত্তেজিত করার জন্য তাদের মান-সম্মান, পৌরুষ ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করতেন।

তারপর সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে ঢোল, ঠগর, ঠুংরি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে জনবহুল হাট-বাজার, মেলা, উপাসনালয় প্রভৃতি লোকসমাগমস্থলে জমজমাট কবিতার আসর বসাতেন। কখনোসখনো তারা বিভিন্ন পাড়া, মহল্লা, কবিলা ও কাফেলায় উপস্থিত হয়ে কবিতা শুনিয়ে আসতেন। জাহেলি যুগের কবি, কাব্য প্রতিভা এবং আরবি ভাষার অতুলনীয় মাধুর্যের কারণে কবিতা পাঠের আসরই ছিল তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় বিনোদনের কেন্দ্র। ফলে সে যুগে যত যুদ্ধ হয়েছে তার বেশির ভাগই ভাড়াটিয়া কবি, সাহিত্যিক, দুষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং তাদের চ্যালা-চামুণ্ডাদের কারণে হয়েছে।

আইয়ামে জাহেলিয়ার রাজনীতির হাতিয়ার যেমন ছিল যুদ্ধ তেমনি রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল কায়েমি ব্যক্তি ও গোত্রস্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিপক্ষের শক্তিশালী পুরুষদের নির্মূল করা এবং দুর্বল ও অসহায়দের ক্রীতদাস বানানো। এ ছাড়া নারী ও শিশুদের যৌনদাসী বা দাস হিসেবে ব্যবহার, বিক্রয় ও বিপণন করা। অধিকন্তু তারা পরের ধন-সম্পত্তি হরণ করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে চৌর্যবৃত্তি ও ডাকাতির স্বভাবকে বিধিবদ্ধ ও আইনসিদ্ধ করা এবং সব অপকর্মকে নিজেদের পক্ষে জায়েজ করে নিত। অন্যের ঘরবাড়ি, জায়গা-সম্পত্তি, সুন্দরী বধূ, কন্যা ও দাসীদের সহজে লাভ করার জন্য জাহেলরা যুদ্ধকেই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি বলে বিবেচনা করত। সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, বিকৃত যৌনাচার এবং নিজের মধ্যকার পাশবিকতাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য তারা যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও অশান্তির অশান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে সবচেয়ে মোক্ষম বলে বিবেচনা করত।

জাহেলদের আরো একটি ভয়ঙ্কর বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা যুগ-যুগান্তরের সভ্য সমাজে ব্যাপকভাবে নিন্দিত এবং অভিশাপের পাত্র হয়ে আছে। তারা সম্মানিত লোকদের মর্যাদাহানি করত এবং মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গ প্রদর্শন করত। তাদের কথাবার্তা, আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি ছিল ভয়াবহ রকমের বিরক্তিকর এবং অশ্লীল। তারা মদপান করা, প্রকাশ্যে ও সদলবলে যৌনাচার করা এবং বিশেষ উৎসবের দিনে উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করার প্রথা সমাজে চালু করেছিল। নারীর মর্যাদা কোনো ভোগ্যপণ্যের চেয়ে অধিক ছিল না। ধর্ষণ, নারী অপহরণ, নারী হত্যা, শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া ইত্যাদি কুকর্ম নিন্দিত ছিল না এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব কাজের জন্য কোনো শাস্তি পেতে হতো না। অভিজাত বংশের পুরুষ বিশেষ করে পুরোহিত, সর্দার কিংবা রাজা ও যুবরাজদের বেশ তোয়াজ-তদবির করে উচ্চাভিলাষী দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের লোকজন নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসত এবং নিজ নিজ স্ত্রীদের সঙ্গে ওসব লোকদের রাত যাপন করাত অভিজাত রক্তের সন্তান লাভের আশায়। তারা আপন কন্যাদেরকে উপহার হিসেবে অভিজাত পরিবারগুলোতে পাঠাত তাদের যৌনদাসী হিসেবে সেবা করার জন্য।

জাহেলি যুগের সমাজপতিদের মন-মানসিকতা ও চরিত্র বিকৃত হয়ে পড়েছিল। তাদের কর্মে কোনো নীতিনৈতিকতার বালাই ছিল না। আইন-কানুন, ধর্মকর্ম, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব কিছুই তারা নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিত। তারা সহজে কাউকে অনুসরণ করত না এবং নিজেদের ব্যতিক্রমী ও শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করত। সারা জাজিরাতুল আরবের গোত্রগুলো তিন শত ষাট ভাগে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রই ধর্মকর্মের জন্য আলাদা খোদা বানিয়ে সেই খোদার মূর্তিকে পূজা করত। তাদের উপাসনাপদ্ধতি, খোদা নির্বাচন এবং ধর্মকর্মের নামে অশ্লীল কাজকর্মের সঙ্গেও রাজনৈতিক ব্যাপার জড়িত ছিল। তারা সব কিছুর ওপর নিজ দলের লোকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিত। আবার দলের ওপর রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজন প্রাধান্য পেত। সর্বেপিরি, সব কিছুর ঊর্ধ্বে ব্যক্তিস্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা হতো। স্বৈরাচার, অনাচার, ব্যভিচার, অত্যাচার, ভ্রষ্টাচার ইত্যাদি শব্দমালা এবং জাহেলি যুগে পরস্পরের প্রতিভূ হয়ে মজলুমকে ক্রমাগত কষ্ট দিয়ে থাকত।

জাহেলি যুগের রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিকৃত বিনোদন। তারা যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে একধরনের বিনোদনের মাধ্যমে নিজেদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করত। যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা বাহারি বিনোদনে নিজেদের ভোগবাদী সত্তাকে তৃপ্ত করত এই বলে যে- যদি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে অথবা জীবনাবসান হয় তাহলে তো আর ফুর্তি করার সুযোগ থাকবে না। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে জয় লাভ ঘটলে যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, নারী এবং প্রতিপক্ষের রক্ত, আহাজারি ইত্যাদির সমন্বয়ে তারা নারকীয় উল্লাসের মাধ্যমে নিজেদের বিনোদিত করত। যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি, সর্দার, সৈনিক কিংবা রাজা সবাই যেমন একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে অশ্লীল ও অনৈতিক কাজ মিলেমিশে ভাগেযোগে করত তেমনি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারা সেটা অব্যাহত রাখত। যুদ্ধের ময়দানকে তারা বন্ধু নির্বাচনের এবং মন্দকর্মে প্রশিক্ষিত হওয়ার নিকেতন মনে করত। তারা অহরহ মিথ্যাচার, দম্ভ প্রদর্শন এবং ভেলকিবাজির মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত ও হতোদ্যম করে ফেলত।

জাহেলিয়াতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল শান্তি-সংহতি এবং মানবতা। চক্রান্ত, কূটকৌশল, প্রতারণা ও ছলচাতুরী ছিল রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাজনীতিবিদরা সব সময় অস্থির থাকতে ভালোবাসতেন এবং অশান্ত পরিবেশে স্বার্থসিদ্ধিকে প্রাধান্য দিতেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা প্রদর্শন ছিল তাদের চিন্তাচেতনার বাইরে। অন্যের ধনসম্পত্তিকে স্বীয় সম্পত্তি মনে করা এবং তা হরণ করাকে তারা অন্যায় বলে মনে করতেন না।

তারা তাদের কুকর্মের সঙ্গী-সাথীদের নিজেদের মতো ভালোবাসতেন এবং হামিম বা বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন। তারা আহারে-বিহারে এবং বিনোদনে পরস্পরের কুকর্মের সঙ্গী-সাথীদের জড়ো করে একত্রে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়তেন এবং যেকোনো অশ্লীল কর্মে একে অপরের প্রতিভূ। সাক্ষী বা উৎসাহদাতারূপে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতেন। লজ্জা-শরম, সৌজন্য, ভদ্রতা ইত্যাদি শব্দমালা জাহেলিয়াত যুগে বিশেষ করে জাহেলিয়াতের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া সত্যিকার অর্থেই দুষ্কর ছিল।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের পর প্রায় দেড় হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর রাজ্য-রাজা এবং রাজত্বের ইতিহাসে বহু সভ্যতার উপাখ্যান যেমন সৃষ্টি হয়েছেÑ তেমনি অসভ্যতামির ইতিহাসও কম নয়। যেখানে সভ্যতার কিছু ঘটে সেখানে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে-নতুন ইতিহাস রচিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো কালে অসভ্যতামি শুরু হলে পৃথিবীবাসী সেগুলোকে সব সময় আইয়ামে জাহেলিয়াতের সাথেই তুলনা করে থাকে। কারণ সভ্যতার রয়েছে বাহারি নান্দনিকতা, নৈসর্গিকতা এবং ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীলতা। অন্য দিকে, অসভ্যতার মধ্যে যে বর্বরতা, পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা এবং নির্মমতা থাকে তা সব কালে-সব যুগে এবং সবার তরে প্রায় একই রূপ তাণ্ডব নিয়ে হাজির হয়ে যায়।

ফলে জাহেলিয়াতের রাজনীতির মূলনীতি যেমন আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে জাজিরাতুল আরবে ছিল তা ২০১৮ সালে পৃথিবীর কোনো ভূখণ্ডে এসে ব্যতিক্রমী রূপ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।

লেখক :গোলাম মাওলা রনি
সাবেক সংসদ সদস্য

Share