অপারেশন থিয়েটারে গল্প চলছে…নারী কন্ঠের গল্প। ঠিক গল্প না এলোমেলো কথাবার্তা। কখনো মনে হচ্ছে কেউ একা বলছে কখনো মনে হচ্ছে অনেকে বলছে আবার কখনো সবাই বলছে।
কেউ শুনছে না তবে, গল্প চলছে। মশা কামড় দেবার আগে কানের কাছে যেমন ভনভন করে গল্পের সুরটা ঠিক তেমন। চরম বিরক্তিকর।যেন পুরো মস্তিষ্কের চুড়ায় বসে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে।
কিন্তু থামার কোন লক্ষণ নেই যেন বর্ষার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু আছে শেষ নেই!
অথচ অপারেশন চলছে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পায়ে ব্লক আছে তাই পায়ের বাইপাস অপারেশন চলছে পায়ের শিরা তুলে ধমনীর সাথে লাগিয়ে ব্লক বাইপাস করা হচ্ছে। আমার পজিশন সার্জনের জায়গায় স্যার আমাকে সহায়তা করছেন এমন সময় যদি অপারেশন থিয়েটারে গল্পের বুদবুদ চলতে থাকে তবে, কার ভাল লাগে!
স্যার একটু অমনোযোগী আমার দিকে তাকালেন কিছু বললেন না তবে, স্পষ্ট বোঝা গেল উনিও গল্পের শব্দে বিরক্ত এবং এও বুঝতে চাইলেন গল্পের শব্দে আমার কোনো রিয়্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) আছে কিনা।
আমি সিস্টারের দিকে তাকালাম না, ব্যাচারা একাই এবং কারো সাথে কথা বলছে না! স্যার আবারও আমার দিকে তাকালেন এবারও কিছু বললেন না।
তবে বুঝলাম কিছু বললে, স্পষ্ট বলতেন-সাকলায়েন, গল্পের শব্দে তোমার কি বিরক্ত লাগছে না?
স্যারকে ক্যামনে বোঝাই, গল্পের শব্দে আমার মস্তিষ্ক ততক্ষণে ১০০ ডিগ্রী তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে গল্পের আয়ু প্রায় ৩০ মিনিট অতিক্রম করেছে। সব কিছুরই বিজ্ঞাপন বিরতি থাকে কিন্তু এই গল্পের যেন তাও নেই থামছে না বিরক্তির কোলে জন্ম নেয় রাগ সে রাগ অপেক্ষাকৃত দূর্বলের উপর ঝরে পড়ে।
এক্ষেত্রেও তাই হলো ওয়ার্ডবয়কে দিলাম এক ঝাড়ি ‘এই, দেখত, বাইরে কেউ গল্প করছে কিনা’।
আমার ঝাড়ির তীব্রতায় স্যার যেন অবাক হলেন আবারও মুখের দিকে তাকালেন মাস্ক আর চশমার আড়ালে তাঁর অভিব্যক্তি এবারও বোঝা গেল না!
ওয়ার্ডবয় ফেরত এলো…মস্ত বড় এক আবিষ্কারকের ভাব নিয়ে নিরাশার বাণী শোনাল… ‘না, স্যার…বাইরে কেউ গল্প করছে না’।
স্যার এবার আমার দিকে তাকালেন এমনভাবে তাকালেন যেন সব দোষ আমার…যেন বলেই ফেলবেন…সাকলায়েন, এতোক্ষণ ধরে গল্পের শব্দ তোমার কাছ থেকেই আসছিল!
মুখে শব্দ ফুটল তাঁর না সেরকম কিছু বললেন না সাকলায়েন, একটা জিনিস খেয়াল করেছো শব্দগুলো মনে হচ্ছে আশেপাশে থেকেই আসছে আমি কান খাড়া করলাম তাইতো খুব কাছের শব্দ কিন্তু মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না মেয়েলি শব্দ এলোমেলো শব্দ!
ওয়ার্ডবয়কে কাছে ডাকলাম পকেটে থাকা মোবাইলটা বের করতে বললাম গাউনের নিচে হাত দিয়ে ওয়ার্ডবয় মোবাইল বের করে আনলো স্ক্রিনটা আমার দিকে তুলে ধরল রিসিভ কল ডিউরেশন ৩৭ মিনিটে ২১ সেকেন্ড
বউয়ের কল ছিল! রিসিভ করার পর কাটা হয় নি। বউ ম্যডামও কাটেননি। সে ডিউটিতে ওয়ার্ড রোগীদের সাথে তার হা হা—বাম বাম—ডান ডান মার্কা কথা ভেসে আসছিল এতোক্ষণ!
সবাই নির্বাক! স্যারকে অনুরোধ করলাম সুতাটা একটু টেনে ধরতে সহকারীকে বললাম, সুতায় একটু পানি দাও কেমন ড্রাই হয়ে গেছে। সেলাই করতে ভয় লাগছে কখন ছিঁড়ে যায়। মনিটরটা হটাৎ শব্দ করতে লাগল অটো প্রেসার মাপার শব্দ। প্রেসার ভালই আছে। ভালো আছে সব কিছুই। অপারেশন চলতে থাকলো শব্দহীনভাবে। (লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক– ডা. এসএমজি সাকলায়েন রাসেল,
ভাসকুলার সার্জারী বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সংবাদ পাঠক ও চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক- মাই টিভি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur