মিজানুর রহমান রানা :
মোহাম্মদ আলী (২৪) ও ফাতেমা-তুজ-জোহরা (২৩)। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দম্পতি। সাধারণের ভাষায় তারা অন্ধ। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। প্রেমের সফল সমাপ্তি ঘটে বিয়ের মাধ্যমে। সেই প্রেম এখনও অটুট রয়েছে। তাতে এতটুকু চিড় ধরেনি।
একজন আরেকজনকে চোখে দেখেন না। কে দেখতে কেমন তা-ও জানেন না। যন্ত্রণাময় হলেও সেই কষ্ট অনেকটাই সয়ে ফেলেছেন তারা। একে অপরকে ভালবাসেন মনপ্রাণ উজাড় করে। পরম মমতায় দু’জন দু’জনকে আগলে রাখেন। আলী-ফাতেমা তাদের শিশু সন্তান আরাবকে নিয়ে থাকেন মিরপুর, সেকশন-১, ব্লক নিউ সি, রোড- নম্বর-৫ এর ২৯ নম্বর ভবনের দোতলায়। সেখানে কথা হয় দু’জনের সঙ্গে। অন্যের মুখাপেক্ষী হতে চান না তারা। আলী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ান। জাতীয় অন্ধ সংস্থা ও অন্ধ কল্যাণ সমিতির বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নেন দু’জন। ওখান থেকে কিছু রোজগার হয়। এই দিয়ে তিনজনের সংসার চলে।
জানালেন তাদের প্রেম- ভালাবাসা ও জীবন কাহিনী। আলী জানান, ৫ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তার দুই চোখের আলো নিভে যায়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। চোখের আলো ফেরেনি। আলীর দুই চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে গেছে। রেটিনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবনে আর কখনও পৃথিবীর আলো দেখা হবে না। দৃষ্টি হারালেও মনোবল হারাননি মো. আলী। বরিশাল থেকে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায়। মিরপুর-১৪ এলাকার জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ব্রেইল (দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে পড়াশোনা) পদ্ধতিতে পড়াশোনা ও শ্রুতিলিখন (অন্যের বলার মাধ্যমে লেখা) পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন তিনি। এরপরই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তার। মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হন খিলক্ষেত জানে আলম উচ্চ বিদ্যালয়ে। একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় এ গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এ গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য একই কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে এখন পরীক্ষা দিচ্ছেন আলী।
আর তার সহধর্মিণী ফাতেমা-তুজ জোহরা ছোটবেলায় টাইফয়েড ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আর কখনও চোখে দেখবেন না ফাতেমা। তখনই সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের করশালিকা গ্রাম থেকে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় অবস্থিত জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রে। সেখান থেকে ব্রেইল ও শ্রুতিলিখন পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর একই পদ্ধতিতে মাদারীপুর জেলার কূলপদ্ধি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ-গ্রেডে এসএসসি ও ২০১২ সালে মিরপুর-২ এলাকার শেখ ফজিলাতুন্নেসা ইসলামিক মহিলা কলেজ থেকে বি গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হয়েছেন মিরপুর বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। একই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করলেও আলী ও ফাতেমার কখনও যোগাযোগ হয়নি। কথাও বলা হয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগে ফাতেমা হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন মিরপুরের ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ড-এ। সেখানে আলীর এক কাজিন তার সহপাঠী ছিল। বলেছিল ফাতেমার মুঠোফোনে খোঁজ করলেই তাকে পাওয়া যাবে। প্রথম দিনেই ফাতেমা-তুজ-জোহরার কণ্ঠস্বর শুনে ভাল লেগে যায় আলীর। সেই থেকে কাজিনকে খোঁজ করার অজুহাতে প্রতিনিয়তই কথা হতো। কথা বলে আলীকেও ভাল লেগে যায় ফাতেমার। ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। এবার সাক্ষাৎ করার পালা। প্রথম দিনের সাক্ষাতের স্মৃতি মনে করে দু’জনই উচ্ছ্বসিত হন। আলী বলেন- সেটা ২০১০ সালের মার্চের প্রথম দিকে। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি ছিল সেদিন। দেখা করার জন্য মিরপুর-১ নম্বর এলাকার ফুটওভার ব্রিজকে নির্ধারণ করা হলো। একজন পথচারীর সহযোগিতায় ওখানে উঠেই ওর জন্য অপেক্ষা করছি। কি যে আনন্দ হচ্ছে তখন! ফাতেমা এলো। আমাদের কথা হলো। এরপর প্রতিনিয়তই বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, বেড়ি বাঁধসহ নানা জায়গায় ঘুরতে বেরিয়েছি। রিকশায়, নৌকায় করে ঘুরেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। পাশাপাশি বসে হাতে হাত রেখে কথা বলেছি। আমরা তো অন্ধ তাই বেশিদূর যেতাম না। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতো। মোবাইল না থাকায় ডেটিং স্পটে গিয়ে কখনও কখনও ঝুনঝুনি (বাচ্চাদের খেলনা) বাজিয়ে একজন আরেকজনের অবস্থান জেনে নিতাম। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আলী বলেন ভালবাসার জন্য অনেকের কটূক্তিও শুনেছি। আশপাশের মানুষরা বলতো অন্ধ, কানাদের আবার প্রেম- ভালবাসা কি? তারা হাসাহাসি করতো। তখন কষ্ট হতো। একসময় পাত্তা দিইনি। জীবনে কখনও ভাবিনি একজন অন্ধ ছেলেকে একটি মেয়ে ভালবাসবে, বুকে টেনে নেবে। আমার ভালবাসার মানুষটিও অন্ধ। তাতে কি! মন তো আর অন্ধ নয়? ফাতেমা জানান, প্রথম প্রথম খুব ভয়ে থাকতাম। অন্ধ হয়ে প্রেম করার অপরাধে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। অনুশোচনা হতো। কিন্তু ওর (আলী) ভালবাসা ও মমতা আমাকে সাহসী করে তোলে। আমরা তো অন্ধ তাই একে ওকে জিজ্ঞাসা করে একজন আরেকজনের হাত ধরে নির্দিষ্ট ডেটিং স্পটে হাতড়ে হাতড়ে যেতাম। একসময় আলী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। তাকে বললাম আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে। আমার মা, বাবা ঢাকায় এসে ওকে দেখে প্রথমে রাজি হলো না। অন্ধ মেয়ের স্বামী হবে অন্ধ পুরুষ। তাতে মেয়ের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কিন্তু আলী নাছোড়বান্দা। আমিও ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি তো অন্ধ, তাই বুঝেছিলাম অন্ধ আলী আমাকে বুঝবে। সুস্থ কোন মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সারাজীবন করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হবে। তা হতে চাইনি। আলী ও ফাতেমার প্রায় একবছর প্রেমের সফল সমাপ্তি ঘটে বিয়ের মাধ্যমে। ২০১০ সালের ২৪শে জুন মিরপুরের ২ নম্বর সেকশনের একটি বাসায় পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। ২০১২ সালের ১৯শে জুন আলী ও ফাতেমার কোলজুড়ে আসে শিশু সন্তান। তার নাম রাখা হয় আহানাব ইসফার আরাব। আরাবকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন। প্রিয় সন্তানের মুখটি তারা দেখতে পান না। এ কষ্ট মাঝে মাঝে পীড়া দেয়। তবে সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়নি। চিকিৎসকরা বলেছেন দৈবাৎ দুর্ঘটনা না ঘটলে সে আশঙ্কা নেই। ফাতেমা জানান, চোখে দেখতে না পেলেও অন্যের মুখে শুনেছেন তার ভালবাসার মানুষ আলীকে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্টে দারুণ মানায়। এ দৃশ্য মাঝে মাঝে কল্পনায় আনেন তিনি। আলীও জেনেছেন খয়েরি সালোয়ার কামিজ কিংবা একই রঙের শাড়িতে ফাতেমাকে অসাধারণ লাগে।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের কথা জানালেন আলী ও ফাতেমা। ফাতেমা পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলে আরাবকে দেখাশোনা ও ঘরকন্নার কাজ করেন। আলী তাকে পরম মমতায় সাহায্য করেন। সমাজসেবার কথা বললেন দু’জন। বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার লক্ষ্যে কাজ করছেন এখন থেকেই। দু’জনেই বলেন আমাদের চোখে আলো নেই। তাতে কি? শিক্ষার আলো তো আছে। সেই আলো সমাজের অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।
এমআরআর/2015