জাতীয়

‘এদেশে অন্ধকে অন্ধ পথ দেখায় আর ভ্রান্তকে ভ্রান্ত উপদেশ দিচ্ছে’

‘আমি তো আন্তরিকভাবেই শুভবুদ্ধির উদয় চেয়েছি। আমি ক্ষোভের সঙ্গে বলিনি। আমি সর্বজনীন মঙ্গলের কথা বলেছি। সেই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। আমি ৫৩ বছর যাবৎ লিখছি। ৫৩ বছরে ভুল করতে পারি। কিন্তু লোভে, লাভে কিংবা ভয়ে আমি কিছু লিখিনি।’

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন নিহত দীপনের অশ্রুসিক্ত মা। দরজা খোলা, শোয়ার ঘরে চেয়ারেই ঘুমিয়েছিলেন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। এক সময় যে বাসা নাতনীদের কোলাহলে মুখর থাকত, সেই বাসাতেই এখন পিনপতন নিস্তব্ধতা।

নিহত জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেমের পরীবাগের বাসায় মঙ্গলবার সকালে গিয়ে এই দৃশ্য চোখে পড়ে।

সকালে দীপনের বাবাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। দীপনের মা কাদের সিদ্দিকীকে দেখেই বললেন, ‘আপনারা আজ এসেছেন। কাল আসবেন না। কিন্তু আমার একমাত্র সন্তান তো আর ফিরে আসবে না। আমার কাজ কে করে দেবে। আমি কাকে নিয়ে থাকব। আপনারা দু-তিন দিন পর ভুলে যাবেন। আমি কি আমার সন্তানকে ভুলতে পারব?’

এ কথা বলেই কাঁদতে কাঁদতে সোফা থেকে উঠে গেলেন নিহত দীপনের মা। একটু পর আবার এসে বললেন, ‘দীপনের বাবা তিন দিন একটুও ঘুমায়নি। দিন-রাত শুধু কাঁদে। মানুষের সামনে তো আর কাঁদতে পারে না। তাই একা একাই কাঁদে। একটু বসুন ডেকে দিচ্ছি।’

কিছুক্ষণ বাদে এলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি শুরুতে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও কিছুক্ষণ চুপ থেকে অঝোরে কাঁদতে থাকেন।

এর পর নিজেই বলেন, ‘দেশের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনা তো আছেই। তার পরও বাঁচতে তো হবে। যেভাবে দেশ চলছে তার পরও তো বাঁচতে হবে। হত্যা, মৃত্যু, প্রতিহিংসা- এগুলো বন্ধ করতেই হবে। আমার ছেলের বয়স ছিল ৪৩। ও ভাল ছাত্র ছিল। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। এমএ পাস করার পর বলল, সে চাকরি করবে না। তার বই প্রকাশনায় আগ্রহ। আমি চাইনি। ও চাকরি করুক এটাই আমি চেয়েছিলাম। কারণ, নিরাপত্তার অভাব। তার পরও জাতি উপকৃত হোক, সংসার চললেই আমি সন্তুষ্ট।’

তারপর হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে আবুল কাসেম বলেন,‘ দীপনের একটা ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। গতকাল পরীক্ষা ছিল। আজও বিকেলে পরীক্ষা। ওদের তো বাবা নেই। ওদের কী হবে? আমার তো ছেলে নেই।’

কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেম আরও বলেন, ‘আমি বলেছি, আমি কোনো বিচার চাই না। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। একপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছে, এর প্রতিক্রিয়ায় আরেকপক্ষ রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে। এই হিংসা-প্রতিহিংসা দিয়ে কাজ হবে না। আমি দুই পক্ষেরই শুভবুদ্ধির উদয় চেয়েছি। যারা সমাজের নেতৃত্ব দেবেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’

তিনি লেখক শাহরিয়ার কবিরের টকশোর মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘শাহরিয়ার কবির বলেছেন, আমি মার্কসবাদী। আমি কীভাবে উগ্রদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় চাই। আমি জানি, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে না। কিন্তু তাদের বাইরে যারা উগ্র আছেন তারা তো জাগবে। দুই পক্ষেই তো উগ্র আছে।’

এর পর বঙ্কিমচন্দ্রের কবিতার দুই লাইন উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘এদেশে অন্ধকে অন্ধ পথ দেখায় আর ভ্রান্তকে ভ্রান্ত উপদেশ দেয়। দুই পক্ষই জাগ্রত হোক।’

আবুল কাশেম বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ছাত্র-তরুণদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ জাগবে। শুভবুদ্ধির পরিচালনায় মানুষ জাগবে।’

দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘এমন হওয়া উচিত না। আজ বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। সেটা এক রাজনীতি। জাতীয় পার্টিও তো রাজনৈতিক দল। তাদেরও প্রতীক রয়েছে। তারাও তো নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিল। এর মধ্যে এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হল। এগুলো কি বৈধ ঘটনা ছিল? দেশবাসী কীভাবে এগুলোকে বৈধ বলবে? এই সংসদকে কীভাবে বৈধ সংসদ বলা যায়। জাপা তো নির্বাচনে ইচ্ছাকৃতভাবে যায়নি। যেভাবে জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রী ঘুষ দেওয়া হয়েছে তা কি বৈধ?’

আওয়ামী লীগের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরে আবুল কাসেম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এদেশের সব সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। চিরদিন সেই নেতারা এদেশের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তাদের ব্যবহার করে যেভাবে দেশ চলছে, এভাবে দেশ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।’

এর পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এই অধ্যাপক।

ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন, ‘যেভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, ও অত্যন্ত মিষ্টি চেহারার ছিল। সুদর্শন ছিল। আপনারা খোঁজ নিন। ওর কোনো শত্রু ছিল না।’

তিনি আওয়ামী লীগের একজন নেতার নাম না দিয়ে তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি তো আন্তরিকভাবেই শুভবুদ্ধির উদয় চেয়েছি। আমি ক্ষোভের সঙ্গে বলিনি। আমি সর্বজনীন মঙ্গলের কথা বলেছি। সেই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। আমি ৫৩ বছর যাবৎ লিখছি। ৫৩ বছরে ভুল করতে পারি। কিন্তু লোভে, লাভে কিংবা ভয়ে আমি কিছু লিখিনি।’

তিনি বলেন, ‘আমি বিচার চাইনি। চাই না। যদি দেশের মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হয় সেটাই হবে আমার ছেলের হত্যার বিচার। দেশের রাজনৈতিক মহলের যদি শুভবুদ্ধির উদয় দেখি, সেখানেই আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার পাব।’

এই পুরোটা সময় পুত্রহারা পিতাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। শুধু হাত দিয়ে একবার চোখের জল মুছে অধ্যাপক আবুল কাসেমকে বলেন, ‘স্যার, এবার আমি আসি। দোয়া করবেন।’

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৭:০৭  পিএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার

এমআরআর

Share