পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ‘বৈষম্যবিরোধী ‘গ্রাফিতি’

আগামি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে গণঅভুত্থানের ‘গ্রাফিতি’ অন্তুর্ভৃক্ত হচ্ছে। সময় স্বল্পতার কারণে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট পাঠ্যবইয়ে এবার লেখা আকারে থাকছে না।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ,ব্যাক কাভার, ইনার কাভার ও ইনার পেজগুলোর অলঙ্করণ হিসেবে ‘গ্রাফিতি’ ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবইয়ে অলঙ্করণ হিসেবে এসব গ্রাফিতি ব্যবহার করা হবে কীনা সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে অধিকাংশ বইয়ের ব্যাক কভার বা ইনার পেজে ‘গ্রাফিতি’ অর্থাৎ বিভিন্ন ‘ছবি’ বা ‘বাণী’ থাকবে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, শিক্ষাক্রমের কন্টেন্ট পরিমার্জন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে দেশের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান,শেরে বাংলা একে ফজলুল হক,আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অবদানকে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের ‘স্পর্শকাতর’ সব বিষয় ছেঁটে ফেলা হচ্ছে।

এনসিটিবির একজন সদস্য জানিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে যার যেমন অবদান….অতিরঞ্জন নয়, আবার খাটো করেও নয়…. সেভাবেই পাঠ্যবইয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে ওইসব সংশোধনী থাকবে। ‘বিতর্কিত’ বা ‘অতিরঞ্জিত’ কিছু তথ্য ও ছবি পাঠ্যবই থেকে এবার বাদ দেওয়া হচ্ছে।

এনসিটিবির দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সে জন্য ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে এবার মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত ওই শিক্ষাক্রমের বই পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সেসব বইয়ের ‘ছোট খাটো’ সংশোধনী ও পরিমার্জনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ‘গাফিতি’ পাঠ্যবইয়ের কভার পেইজ ও বইয়ের ভেতরে পেইজে অন্তর্ভুক্তির জন্য একাধিক সভায় প্রস্তাব করেন সংস্থার সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এএফএম সারোয়ার জাহান। এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন হয়।

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর আতœগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারা। তাদের অনেকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।

সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের দেশের বিভিন্ন দেয়াল, সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে গণঅভ্যত্থানের নানা স্লোগান, বাণী ও অভিমত বা ‘গ্রাফিতি’ লেখা হয়। বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আঁকা এসব গ্রাফিতিতে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা, স্বৈরাচার সরকারের পতন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নিপীড়নের প্রতিবাদসহ নানা চিত্র তুলে ধরা হয়। এগুলিকেই গণঅুভ্যত্থানের ‘চেতনা’ হিসেবে মনে করছেন পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা।

এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের চেতনাকে ধরে রাখতে নতুন পাঠ্যবইয়ে কোন কন্টেন্ট অর্ন্তভুক্ত করা যায় কীনা এমন চিন্তা-ভাবনা ছিল। আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দেয়ার বিষয়টি সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়ের অভাবে ‘কন্টেন্ট’ অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বাতিল করা হয়। তবে অলঙ্করনের মাধ্যমে গ্রাফিতিগুলোকে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব ওঠলে তা গ্রহণ করা হয়।

জানা গেছে, আলোকচিত্রি শহিদুল আলমের নেতৃত্বে একটি কমিটি পাঠ্যবইয়ের জন্য ‘গ্রাফিতি’ বা এ সংক্রান্ত ছুবি সংগ্রহ ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এনসিটিবি জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঠ্যবই সংশোধনের শেষ সময়সীমা ছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। ইতিমধ্যে শিক্ষাক্রম সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ করে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের কাছে তা হস্তান্তরের পর্যায়ে রয়েছে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সংশোধিত বই হস্তান্তর করবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাকটিভ লার্নিং

এনসিটিবির অন্য এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই গতবছরও ‘অ্যাকটিভ লার্নিং’ বা সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও এ স্তরের বই নিয়ে তেমন কোন সমস্যা বা কারো আপত্তি নেই।

নতুন শিক্ষাক্রমে ‘এক্সপিরেন্সিয়াল লার্নিং’ বা অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতিতে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই প্রণয়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে ২০১২ সালের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করে সক্রিয় শিখন পদ্ধতিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিরর বইয়ের সঙ্গে ‘অ্যালাইনমেন্ট’ বা একই রেখায় বিন্যস্তকরণ করা হচ্ছে। তবে ২০২৬ সালের পাঠ্যবই সংস্কারের সময় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বই সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।

এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এএফএম সারোয়ার জাহান সংবাদকে বলেন, ‘ প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত প্রত্যেকটি শ্রেণি যাতে অন্য শ্রেণির সঙ্গে সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে অ্যালাইনমেন্ট করে যাওয়া হয়, সে বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

প্রাথমিকের শিক্ষাক্রমে বড় সমস্যা নেই

এনসিটিবির কর্মকর্তাদের দাবি, প্রথামিকের শিক্ষাক্রম নিয়ে বড় কোন সমস্যা নেই। তবে মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গত নয় মাস ধরে নতুন কারিকুলামের বই পড়ছে। এসব বই পড়ার মত কিছু না থাকা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল।

চলতি শিক্ষাবর্ষ প্রায় শেষের দিকে। সেজন্য বই পরিবর্তন করে কিছু করার সময় নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এনসিটিবি থেকে ইতোমধ্যে শিক্ষাবর্ষের বাকি সময়ের জন্য সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র তৈরি করে স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে।

একই সঙ্গে ২০২৫ সালের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১২ সালের বই পরিমার্জন ও সংশোধন করে উৎপাদন ও বিতরণের কাজ চলছে।

এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সংবাদকে বলেন,‘২০২৫ সালের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কারিকুলাম উন্নন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি সবসময়েই প্র্যাকটিস করতে হয়।’

ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সম্প্রতি এনসিটিবি থেকে স্কুল পর্যায়ে সিলেবাস পাঠানো হয়েছে। এ সিলেবাস অল্পসময়ে শেষ করে পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে বলে অভিভাবকরা মনে করছেন।

এ বিষয়ে এনসিটিবির এ সদস্য বলেন,‘ এক্ষেত্রে বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মতো করে সমাধান করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের বাকি সময়ে সিলেবাস যতটুকু শেষ করা যাবে তার ওপরেই তারা পরীক্ষা নিতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকার পুরনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের আর মাত্র তিনমাস বাকি। এ সময়ের মধ্যেই নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ে পরিমার্জন ও সংশোধনের পাশাপাশি মূল্যায়নের পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।

এর ধারাবাহিকতায় পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধনের জন্য ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান, সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্্য অধ্যাপক এএফএম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব ইয়ানুর রহমান।

পরবর্তীতে এই কমিটির বিষয়ে আপত্তি জানান ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতারা। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে আলেম ও ইসলামী স্কলার অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানায় খেলাফত মজলিস। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর এ কমিটি বাতিল করা হয়।

রাকিব উদ্দিন
বৃহস্পতিবার,
৩ অক্টোবর ২০২৪

Share