বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগাধীন, চাঁদপুর জেলাধীন ফরিদগঞ্জ থানার একটি গ্রাম সাচনমাঘ। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসেবে ধরে নিলে ভুল হবে না। ঠিক এমনি ভাবে অন্যান্য বিভাগেও রয়েছে এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে আমার মত করেই অনেকের শৈশব কেটেছে হাসি-কান্না,অভাব অনটন আর সুখ ও দুঃখের সংমিশ্রনে।
ঠিক যেমন করে বন্দে আলী মিয়া তার কবিতায় লিখেছেন, আমাদের ছোট গ্রাম, ছোট ছোট ঘর, থাকি হেতা সবে মিলে নাহি কেহ পর, পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, এক সাথে খেলি আর পাঠশালায় যায় . . . . .। সেখানে সন্ধ্যা হলে সকল ফটিকের মত দুষ্ট কিংবা মাখনের মত বদরাগী ছেলেমেয়ে গুলো পড়াশুনা,খেলাধূলা (দাঁড়িয়াবান্দা,কাঁনামাছি,ঘোল্লাছুট… .) , গল্প-কাহিনী শেষ করে ঘরে ফিরে সুবোধ বালক-বালিকার ন্যায় পড়ার টেবিলে মনোনিবেশ করতো।
কখনো শুনতে হয়নি বা শুনি নি অমুক পাড়ার অমুকের ছেলে আত্মহত্যা করেছে। তবে মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ সবই হত কিন্তু দিনশেষে সবাই আবার একই শুতোয় বাঁধা পড়ে যেত, একই কন্ঠে গাইতো। আর এই সমাজ ব্যবস্থাকে সমাজবিজ্ঞানী ডুরখেইম নাম করণ করেছেন ’যান্ত্রিক সংহতি’।
কালের পরিক্রমায় কিংবা বিজ্ঞানের উন্নয়ন এবং পুঁজিবাদের ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমরা এখন বসবাস করা শুরু করেছি জৈবিক সংহতির সমাজ ব্যবস্থায় যা হলো বৈসাদৃশ্যেও সংহতি। এখানে ব্যক্তির ধ্যান ধারনা, মূল্যবোধ, পেশা সকল কিছুতে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর প্রভাব ও কমে আসে ।
আদিম সমাজে যান্ত্রিক সংহতি দেখা গেলে ও আধুনিক সমাজে জৈবিক সংহতির প্রচলন বেশি।ডুরখেইমের মতে সমাজে শ্রম বিভাজন বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রসারের সঙ্গে জৈবিক সংহতির উত্থান হয়েছে। বিশেষ করে ৯০’র দশকের পরের প্রজন্ম বেড়ে উঠছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আলোকিত সমাজ ব্যবস্থার উপর ভর করে। এই সমাজে ৬মাসের কিংবা ২-৫ বছর কিংবা তার ও বেশি বয়সের একটি শিশুকে খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো সহ আরো নানাবিধ কাজ করতে হয় স্মাট ফোনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও কারসাজির মধ্য দিয়ে।
যা তাদের মধ্যে একটি ইলিউশন তৈরি করে। অথচ আগে সেইসকল বিষয়গুলোর সমাধান ছিল মা-বাব-ভাই-বোনের মুখ নিশ্রিত বিভিন্ন গল্প-ছড়া-গান-কবিতা।
এখনকার প্রজন্ম বেড়ে উঠছে ভিডিও গেমস,স্মাট ফোন, স্মাট টিভি সহ অন্যন্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের উপর ভিত্তি করে যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরের প্রজন্মকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে সহায়তা করছে আস্তাকুড়ে, তৈরি হচ্ছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি একটি জাতির।
তবে হ্যা এটাও অবলীলায় স্বীকার করতে দোষ নেই যে প্রযুক্তি আমাদের জীবনে এনে দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ যা আমাদের সামাজীকীকরন থেকে শুরু করে অনেক কিছুতে বৈসাদৃশ্যের অবতারনা করেছে। নগরায়নের কারনে শহরের গতিপথ এবং অবকাঠামোগত দিকে বিভন্ন অসংঘতি পরিলক্ষিত হয় যা নতুন প্রজন্মের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন করতে হয় তাহলে এই যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছে আর তারা যেকোন বিপদের দিকে নিজেদের কে জড়িয়ে ফেলছে এর থেকে কি উত্তরনের কোন পথ নেই?
অনলাইন গেমস ও আত্মহত্যা
আমাদের সন্তানরা প্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে যুক্ত করছে নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে আর এর মধ্য দিয়েই তারা খুঁজে নিচ্ছে জীবনের মানে এবং তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
কিন্তু এই প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকটার সাথে নিজেদেরকে তারা জড়িয়ে ফেলছে নিজেদের ই অজান্তে যাকে অবচেতন মন বলা হয়। তরুন প্রজন্মের মধ্যে অনেকগুলো অনলাইন ভিত্তিক গেমসের মধ্যে ব্লু হোয়েলস,লুডু স্টার, সিওসি, তিনপাত্তি গোল্ড খুবই জনপ্রিয়। তারা নিজেদের অৎান্তেই ঐসব গেমসের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে গিয়ে কিংবা হেরে গিয়ে আবেগের বশে আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ ও সাবলীল ভাবে গ্রহন করছে অথবা একটা মোহ কিংবা গেমিং নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
এক্ষেত্রে তারা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের তুলনায় প্রাধান্য দিচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক ঐসব গেমস কিংবা স্মাট ডিভাইস সমূহকে। তবে এসবের জন্য আমি তাদেরকে একা দায়ী করতে অপ্রস্তুত। অন্যান্য বিষয়গুলো ও বিবেচনায় নেওয়াটা অত্যবশ্যক বলে আমি মনে করি।
প্রথমত, আসল দায়বদ্ধতাটা আমাদের ত্রুটিয্ক্তু সামাজীকীকরনের মধ্যে। আজকাল বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যে যার মত করে সময় কাটাতে অভ্যস্ত। পরিবারের সবাই মিলে সবাইকে সময় দেওয়াটা এখন আর প্রতিদিনকার কাজ নয় বরং মাসে কিংবা বছরে তা ঘঠে থাকে অধিকাংশ পরিবারেই।সন্তানের আচার আচরনের মধ্যে নতুন কোন মাত্রা যোগ হল কি হলো না তার খবর নেওয়ার সময়টুকু ও বাবা-মায়ের নেই কিংবা লক্ষ্য করলেও তাদের সাথে বসে কথা বলা কিংবা সন্তানদের সমস্যার কারন নিরূপন করার গুরুত্ব উপলব্দি করতে পারেন না।
অনেক বাবা মা ই অফিস কিংবা নিত্যদিনের কাজ শেষে বাসায় ফিলে সন্তানদেরকে সময় না দিয়ে পূনরায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন তাদের স্মাট ফোন,ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারের মনিটরে যা সন্তানদেরকে আরো বেশি অবহেলার দিকে ঠেলে দেয়। এরকম বিচ্ছিন্নতায় অব্যস্ত হয়ে যাওয়ার করণে তারা একা থাকতে ই সাচ্ছন্ধ্য বোধ করে বেশি যার ফলশ্রুতিতে ওইসকল সন্তানরা কারো সাথে নিজেদের সমস্যাগুলো শেয়ার করতে না পেরে নিজেকে ঘুটিয়ে নিচ্ছে মোবাইল,ইন্টারনেটের মধ্যে যা দ্বারা সে তার মত করে একটা আলাদা জীবনরেখা তৈরি করছে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সামাজিক অবস্থান তরুন প্রজন্মকে এমনভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে আমরা খেলার মাঠ, পুকুর,জলাশয় কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশ কে নষ্ট করে ফেলছি দিনের পর দিন। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে সুউচ্ছ প্রাসাধ আর অট্টালিকা। যা নতুন প্রজন্মকে আরো বেশি ঘরকুনো করে ফেলছে। যা তাদের মুক্ত চিন্তার এবং মুক্ত বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে পড়ছে।
তৃতীয়ত, ভবিষ্যত নিয়ে অপরিনত বয়স থেকেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে হতাশা বসবাস করা শুরু করে, প্রতিনিয়ত তাদেরকে আমরা জড়িয়ে ফেলছি একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে আর সেই প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জের ভার এবং কাঁধে ঝোলানো বই’য়ের ব্যাগ এর ভার সইতে না পেরে তারা হয়ে পড়ছে বিষাদগ্রস্ত, একা আর তখনই যখনই সুযোগ পায় নিজেদেরকে হারিয়ে ,জগৎকে হারি সে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট। বাহিরে বাহিরে তারা নিজেদেরকে স্মাট হিসেবে প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে তারা নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যা তাদেরকে স্মাট না করে আরও বেশি বোকা আর আনস্মাট প্রজন্মে পরিনত করছে।
পরিশেষে, আবুল কালাম আজাদ প্রাসঙ্গিক ই বলেছেন যে , শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটি সমাজে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাব ফেলে, আমাদের শিক্ষার যে প্রদ্ধতি সেটি কিন্তু আমাদের বাঙ্গালি সমাজ ও সংস্কৃতির সমন্বয়ক নয়। ভাঙ্গন বলি আর অবক্ষয় যা ই বলি না কেন এর প্রধান কারনগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতা আর প্রথম হতেই হবে এমন মনোভাব ই মূল কারন। এই বিচ্ছিন্নতা বা অস্থিরতা মানুষে মানুষে , মানুষে ও সংস্কৃতিতে, মানুষ ও সমাজে , সমাজ ও সংস্কৃতিতে সবমিলিয়ে সামাজিক জীব মানুষের আধুনিকতার ছোঁয়ার সাথে সাথে সমসাময়িক সমাজ ও সংস্কৃতির একটা বিশাল দ্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। সমাজ ও সংস্কৃতির ভাঙ্গন ও নতুনত্ত্বকে কি আমরা একভাবে দেখতে পারি? মোটেই না- ভাঙ্গনটা অশুভ, নতুনত্ত্ব আসতেই পারে তবে সেই নতুনত্ত্বের মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা থাকাটা আবশ্যক। ভয়তো সেখানেই – যে ভাঙ্গন একটি সমাজ ও সাংস্কৃতিকে একটি বিপদের দিকে ধাবিত করে আর নতুনত্ত্ব আগের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ করে।
সমাধান কোথায়? আমরা ভাঙ্গনের দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি যা আমাদেরকে এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে করে ফেলছে উদাসীন ও বিষাদগ্রস্ত। নতুনত্তে¦র দ্বারে হলে কোন সংঙ্কাই ছিল না। সুস্থ আধুনিকায়ন আবশ্যক ও অবশ্যম্ভাবী, অসুস্থ আধুনিকায়ন কিংবা অসুস্থ নগরায়ন কিংবা প্রতিযোগিতার নিপাত অত্যবশ্যক। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী র্কাল র্মাকস যথাযতই বলেছেন, ‘’Society is not something that exists over and above people, it’s the product of people’s behavior’’’’. এই যে পুঁজিবাদী প্রযুক্তির রাহু গ্রাসে বলি হচ্ছে হাজারো নর-নারী এবং আমাদের তরুন প্রজন্ম এর জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে সংস্কার আবশ্যক।
শুধু শুধু তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ করাটা হবে নেহাৎ বোকামি। সুস্থ সামাজীকীকরনের পাশাপামি, সুস্থ শিক্ষাঙ্গন, সাবলীল কৃষ্টি সমৃদ্ধ প্রতিযোগিতা যা মুক্ত চিন্তার জগৎকে উন্মোচিত করে মুক্ত বিকাশের দ্বার উন্মোচন করে এবং সেই সাথে সুস্থ মানবিকতাবোধে জাগ্রত মানুষ হবার মাধ্যমেই আমরা আমাদের এই পচন ধরা সমাজব্যবস্থাকে উত্তোরনের উপায় খুঁজে নিতে পারি।
আর আমি বিশ^াস করি সময় সবসময়ই তরুন। তাই নতুনত্ত্বের শুরুটা হোক এখন থেকেই, আর তা হোক প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সাধনের মাধ্যমে আর এই নতুনত্ত্বের আহব্বান হোক, শুধুমাত্র নতুন প্রজন্মের জন্যই নয়, বরং নতুন একটি মানবিকতার সন্ধানে, যেখানে মানুষ জীবন দিবে আর পুঁজিবাদী প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হবে মানুষকে বাাঁচানোর জন্য, কারো জীবন কেড়ে নেবার জন্য নয়। তবেই একটি সুষ্ঠ সুন্দর সমাজ নবায়ন করা সম্ভবপর হবে। আর এক্ষেত্রে নতুন আর পুরাতন দু প্রজন্মই অবদান রাখবে পাঞ্জেরীর ভুমিকায় ।
লেখক: রাসেল হোসাইন, প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
Email: raseldu1971@gmail.com