পরিবারের প্রশ্রয়ে সন্তান কিভাবে নষ্ট হয় তার সর্বশেষ নজির ধর্ষক সাফাত। তার মা, বাবা এবং সাবেক স্ত্রী পিয়াসার কথায় উঠে এসেছে সাফাতের নষ্টামির পেছনে পরিবারের প্রশ্রয় আর অর্থ ঢালার কাহিনী।
সাফাতকে দৈনিক দুই লাখ টাকা দিতেন সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম। কী করত সাফাত দৈনিক দুই লাখ টাকা দিয়ে?
পাঁচতারকা হোটেলে ফূর্তি করা, বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন বার আর পার্টিতে নাচ গান আর পার্টির আয়োজন। আর নারী নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ। হোটেলে যেসব মডেল, নায়িকা, আইটেম গার্লদের নিয়ে একান্তে সময় কাটাত সাফাত তাদের দিতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা আর উপহার। সাথে বিদেশী দামি মদ আর হোটেল ভাড়া। এতে অনেক সময় দৈনিক দুই লাখ টাকায়ও হতো না সাফাতের।
তবে তাতেও চিন্তার কিছু ছিল না তার। টাকার প্রয়োজন হলে আপন জুয়েলার্সের যেকোনো শোরুম থেকে সে যত খুশি টাকা চেয়ে নিতে পারত।
সাফাতের নষ্ট জীবন আর অপকর্ম সম্পর্কে সাফাতের মা বলেছেন, স্কুলে পড়া অবস্থায়ই সাফাত নানা রকম মেয়ে নিয়ে বাসায় আসত, পার্টিতে যেত। আমি বাধা দিতে চাইলেও তার বাবা সব সময় আমাকে বলতো এই বয়সে এমন করেই। এমনকি মদ ও নারী সরবরাহকারী নাঈমকে ঘরে এনে রাখে সাফাতের বাবা এবং সাফাতের সাথে থাকারও আয়োজন করে দেন তিনি।
সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় ধরা খাওয়ার পর গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে বাবা দিলদার আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতেই প্রমাণিত হয়েছে সাফাতের নষ্টামির পেছনে তার ভূমিকার বিষয়টি।
দিলদার আহমেদ সাংবাদিকের কাছে বলেছেন, ‘আরে মিয়া, আমার পোলা আকাম করছে তো কি হইছে। জোয়ান পোলা একটু-আধটু তো এসব করবই। আমিও তো অনেক জায়গায় আকাম করি। করুম না কেন। আমি কি বুড়া হইয়া গেছি নাকি? আমার যৌবন নাই? আমিও তো হোটেলে যাই। আমি এখনো বুড়া হইনি।’
এই যখন বাবার চরিত্র এবং সন্তানের অপরাধ বিষয়ে তার অবস্থান; তখন সেই সন্তান কেমন হতে পারে তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তবে সব চরিত্রহীন দুর্নীতিবাজই যে সন্তানকে নষ্ট বানায় তা নয়। নিজে নষ্ট আর দুর্নীতিবাজ হলেও অনেকে আবার চায় সন্তান ভালো থাকুক, ভালো হয়ে গড়ে উঠুক। সে নজিরও আছে সমাজে।
মা-বাবার লাই পেয়ে সন্তান কিভাবে নষ্ট হয় তার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ ঐশী। পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ঐশীকে মাসে এক লাখ টাকা দিতেন হাত খরচ বাবদ।
অনেকের মতে, ঐশীরা একদিনে নষ্ট হয় না। ঐশী যখন দিনের পর দিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ইয়াবা আর মদের আসর, ডিজেপার্টি আর নাচগানের আসরে মেতে থাকত, গভীর রাতে বাসায় ফিরত তা কি তার মা-বাবা দেখতেন না।
হ্যাঁ, ঐশীকে ফেরাতে চেয়েছিলেন ঐশীর মা। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঐশী এতটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, নষ্টামিতে বাধা দেয়ায় মা-বাবাকে হত্যা করে সে।
অপর দিকে ফরিদপুরে সম্প্রতি মুগ্ধ নামে এক তরুণ নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে।
মা-বাবা তাদের কক্ষে থাকা অবস্থায় সে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। অল্পের জন্য আগুন থেকে বেঁচে যান তার মা।
অনেক মা-বাবা দিনের পর দিন ব্যস্ত থাকেন কাড়িকাড়ি অর্থ উপার্জনে। আর সন্তানের হাতে ঢালেন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা। সন্তান কি করছে তার কোনো খোঁজ রাখেন না তারা। আবার অনেক বাবা উপার্জন করেন অবৈধ টাকা। আর ভোগ-বিলাসের পেছনে উড়ান সে অর্থ। নিজেরা হন নষ্ট তেমনি নষ্ট হয় তাদের সন্তানও। এসব নষ্ট সন্তানের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হচ্ছে অনেক ভালো পরিবারের সন্তানও।
তবে শুধু যে বিত্তবান আর নষ্ট বাবা-মায়ের প্রশ্রয়ে সন্তান নষ্ট হচ্ছে তা নয়। দরিদ্র, সাধারণ পরিবারের অনেকেও এখন নষ্ট হচ্ছে সমাজের মলিন স্রোতের সংস্পর্শসহ নানা কারণে। সমাজের সর্বত্র যে অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়ছে, যেভাবে চারদিকে অনৈতিকতার চর্চা প্রসারিত, অশ্লীলতা আর মাদক যেভাবে হাতের নাগালে চলে এসেছে তাতে সন্তান নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন এখন সব মা-বাবা।
বনানী রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনার পর অনেক অভিভাবক ফোন করে বলেছেন, একটি মেয়ে যখন সংক্ষিপ্ত পোশাকে বাইরে বের হয় এবং এটা যে মা বাবার সামনে করে তারা কেমন মা-বাবা?
কেমন তাদের পরিবার? বর্তমানে মেয়েরা যেভাবে অশালীন পোশাক পরে তা কি দেখেন না তাদের মা-বাবা?
সন্তান যখন দিনের পর দিন নানা অজুহাতে বাইরে রাত কাটায়, গভীর রাতে মাতাল হয়ে, বন্ধুদের সাথে পার্টি করে যখন বাসায় ফেরে তখন কী করেন তাদের মা-বাবা? দিনের পর দিন একই ঘটনা যখন ঘটতে থাকে তখন কি তারা সতর্ক হন?
কী করে তারা এটা মেনে নিতে পারেন? আধুনিকতার নামে, হাইফাই জীবনযাপনের নামে এসব কি হচ্ছে আমাদের সমাজে?
হয়তো দেখা যায় ওই পরিবারের বাবাও রাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরে স্ত্রী-সন্তানদের মারধর করেন। অনেক মাও হয়তো অংশ নেন বিভিন্ন পার্টিতে। অনেক পরিবারে এখন দেখা যায় মা-বাবা ছেলে মেয়ে একসাথে বসে অশ্লীল নাচ-গান দেখছেন।
অনেক পরিবারে মা-বাবার সামনেই সন্তান অশ্লীল নাচগান সিনেমা দেখছে। অথচ নির্বিকার পরিবারের অভিভাবক। তাই অনেকে দাবি করেছেন এই বিষয়টিও সবার ভাবনায় আসা উচিত।
যাদের অবহেলা এবং প্রশ্রয়ের কারণে সমাজে সাফাত, ঐশী আর মুগ্ধরা তৈরি হয় তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তা নাহলে এক ঐশীর মৃত্যুদণ্ড হলেও তৈরি হতে থাকবে হাজারো ঐশী, সাফাত আর মুগ্ধ।
আর মাদকাসক্ত, বখে যাওয়া সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন হওয়ার মতো জঘন্য অপরাধের বারবার সাক্ষী হতে থাকবে সমাজ।