সাধারণ মানুষের ধারণা, বয়স্কদের স্ট্রোক বেশি হয়। কারণ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরলের মতো এমন সমস্যাগুলো বয়স্কদের বেশি থাকে। সম্প্রতি এ ধারা পরিবর্তন হয়েছে। স্ট্রোক এখন কম বয়সেও দেখা যাচ্ছে এবং কর্মক্ষম মানুষদের মধ্যে তা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
দেশে স্ট্রোকের চিকিত্সায় গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালের একটি ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল। গত তিন মাসে স্ট্রোক নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া এক হাজার ৬৬২ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২২.৮৬ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের কম। তাঁদের প্রত্যেকে কর্মক্ষম ব্যক্তি। প্রতি পাঁচজনে একজনের বয়স ৩০ বছরের কম।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য দেশের মতো আজ বুধবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্ট্রোক দিবস’। স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৯ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ’। স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের এক জটিল রোগ।
স্ট্রোক দু প্রকারের হয়। একটি মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে হয়, আরেকটি মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়ে। রক্ত জমাট বাঁধা স্ট্রোকের সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল, ধূমপান ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যাদের এ সমস্যাগুলো থাকে, তাদের এ ধরনের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এখন অনেক কম বয়সে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সে কারণে কম বয়সে অনেকেরই স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতি এক হাজারে ১১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে যেসব রোগী মারা যায় তার মধ্যে ১৮.৭৪ শতাংশই স্ট্রোকে। দেশে প্রতিবছর স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ৫৫ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, দেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। আর ২০২২ সালের এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, প্রতি এক হাজারে ১১.৩৯ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
নিনসের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, স্ট্রোক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। একই সঙ্গে স্ট্রোক একটি রিকভারেবল (পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা) রোগও। প্রতি মিনিটে একজন স্ট্রোকের রোগীর মস্তিষ্কের ১৯ লাখ নিউরন মারা যায়। এ জন্য স্ট্রোকের রোগীর ক্ষেত্রে প্রতিটি সেকেন্ডই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক ও নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা.কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন,‘আমাদের দেশে গ্রামে স্ট্রোক বেশি হচ্ছে,শহরে কম। আমাদের জনসংখ্যা গ্রামে বেশি, তারা স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণগুলো সম্পর্কে মোটেও অবগত নয়। একবার স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর সেবা প্রদানকারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
বেশির ভাগের চিকিৎসা শুরু হয় দেরিতে : সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোকে আক্রান্ত একজন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হতে গড়ে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগছে। এতে ৮৮% রোগীকে জীবন রক্ষাকারী চিকিত্সা থ্রম্বোলাইসিস দেয়া সম্ভব হয় না। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল জার্নালে। গবেষণাটি দেশের পাঁচটি হাসপাতালে পরিচালিত হয়।
নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের চিকিত্সক হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, কম বয়সী অনেকের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তে চর্বির আধিক্য রয়েছে, যা স্ট্রোকের কারণ। এ ছাড়া শুধু ধূমপায়ীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি দুই থেকে তিন গুণ।
ডা.হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন,‘স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রতিটি মিনিটই মূল্যবান। যত দ্রুত বন্ধ রক্তনালি খুলে দেয়া যায়,তত বেশি কোষ বাঁচানো সম্ভব। মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি মস্তিষ্কের বড় অংশকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে। অনেক মানুষ এখনো জানে না যে স্ট্রোকের চিকিত্সা সম্ভব। আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন স্ট্রোক মানেই পঙ্গুত্ব। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে,যাতে মানুষ দ্রুত হাসপাতালে আসে।’
২৯ অক্টোবর ২০২৫
এ জি
চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur