কালো গ্লাসের দুটি হাইস গাড়িতে মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের বসানো হয়। কুমিল্লা হাইওয়ে নিকট ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার কথা ছিল। মেঘনা ব্রিজ পার হলে কালো কাপড়ে বাঁধা হয় চোখ। একাধিক আঙ্গুলে দেয়া হয় ইলেকট্রিক শক। দির্ঘ চিকিৎসায় পরিপূর্ণ ভাল হয়নি। হয়তো আমৃত্যু শারীরিক এ সমস্যা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ‘আয়না ঘর’ নামে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রায় ৩৭ দিনের বন্দি জীবনের দুঃসহ স্মৃতি এভাবেই বর্ণনা করেন সাবেক চাঁদপুর সরকারি কলেজের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য সচিব ও জেলা যুবদল নেতা রফিক মিজি। বয়স ৪০ পেরোনো এ সাবেক ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির বাসভবনের সামনে বোমা হামলা করেছেন। এ প্রতিনিধির সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তার গুম হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত তুলে ধরেন।
জেলা যুবদল নেতা রফিক মিজি বলেন,সময়টা ২০১৩ সাল। আওয়ামী সরকারের শেষ সময়। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। দলীয় সরকারের অধীনে আওয়ামীলীগ সংসদ নির্বাচন করতে অনড়। বিএনপি সহ অধিকাংশ দলগুলো নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছিল। এমনি সময় ৩১শে মার্চ রাত তখন আনুমানিক ১১টা। আমার বাসা চাঁদপুর শহরের প্রফেসর পাড়া পীর বাদশা মিয়া রোড থেকে সদর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ফরিদসহ আমাদেরকে ১৫-২০ জনের সিভিলে এসে জিজ্ঞাসা করে আপনারা রফিক-ফরিদ। আমরা এতো লোক দেখে একটু ভয় পেয়ে বিচলিত হই । আমাদেরকে হাঁটিয়ে মহিলা কলেজ হোস্টেলের সামনে নিয়ে আসে। যা চাঁদপুর পৌর বিএনপি আহবায়ক আখতার হোসেন মাঝি প্রত্যক্ষদশী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে দুইটি কালো গ্লাসের হাইস গাড়ি ছিল। আমাদেরকে গাড়ির মাঝখানে উঠিয়ে বসালো। পনেরো বিশ জনের সাদা পোশাকধারী লোক তাদের গুম করে ।সাদা পোশাকধারী বাহিনী তাদেরকে জোরপূর্বকভাবে মহিলা হোস্টেলের সামনে দুটি কালো হাইস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ।
গাড়ির ভিতরে তাদের দুজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালায়, নানা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।প্রথমে কুমিল্লা হাইওয়ে নিয়ে যায় । ক্রসফায়ার দেওয়ার জন্য ওযু করিয়ে কালেমা পড়ানো হয় । তাদেরকে শর্ত দেয় গাড়ি থেকে পালাতে। পালাতে পারলে ছেড়ে দিবে বলে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে তাদেরকে পালাতে বলে। আমরা না পালিয়ে আকুতি মিনতি করি ছেড়ে দেয়ার জন্য।
মেঘনা ব্রিজ পার হলে চোখ বেঁধে ফেলে। ভোরবেলায় ঢাকাতে নির্জন এক কক্ষে রাখা হয়। ফরিদ এবং আমাকে আলাদা কক্ষে রাখে। সেখানে আরো অনেকগুলো সেল এর মত ছোট ছোট বন্দিশালা রয়েছে । আমাদের কক্ষের আয়তন ছিল ছয় থেকে আট ফুট। দুপুর ও রাতে দুবেলা খাবার দিত। আবার ৪/৫ দিন পর ক্রসফায়ার দেয়ার কথা ছিল। প্রতিদিন ৱ্যাব পুলিশ ডিবি ডিএসবি লোক আসে। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় টর্চার করে। প্লাস দিয়ে দু হাতের আঙ্গুলে প্রচন্ড জোরে জোরে চাপ দিতে। শরীরে ইলেকট্রিক শট দিত। পাহাড়ি লাঠি দিয়ে হাতে পায়ের গোড়ালিতে করতো। জোড়পূর্বক স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য নানা নির্যাতন চালায়। আমার বাবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলে তাদেরকে অনুনয় বিনয় করি। পরবর্তীতে উনারা যাচাই করে দেখেন আমার কথা সত্যি।
দীর্ঘ ৩৭দিন বন্দীশালা আয়নাঘর থেকে বের করে ঢাকা রমনা থানায় হস্তান্তর করে। থানা পুলিশ আমাদেরকে সিএমএম কোর্টে উঠালে পুলিশ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাক্তার দীপু মনির বাসার সামনে বোমা হামলার অভিযোগে শ্যান অ্যারেস্ট দেখায়। মামলার বাদী এসআই মিজানুর রহমান ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রমনা থানার সার্কেল শিবলী নোমান ভিডিও রেকর্ডিং ওপেন করে রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। ৭ দিনের এ রিমান্ডে পুলিশ ছাড়াও ডিএসবি ৱ্যাব পুলিশ ডিবি জিজ্ঞাসাবাদ করে। রিমান্ডে মারধর করে জোরপূর্বক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া, জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক,তৎকালীন জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম কাজী জুয়েল এর নাম বলতে বলেন। কিন্তু আমরা এই ঘটনায় আমরা জড়িত নই তাদেরকে বারবার বলি।মিথ্যা স্বীকারোক্তি না দেওয়ায় আমাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়।
এ ঘটনায় মিডিয়া জানার পর ঐদিনই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ও বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার নিজ আইনজীবী এডভোকেট সানাউল্লাহ সাহেবকে আইন পরিচালনা করার জন্য দ্রুত নিয়োগ দেন । এছাড়া তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও জয়েন্ট সেক্রেটারি মোস্তফা জগলুল পাশা পাপেল কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আরো আইনজীবী নিয়োগ দেন। পাশাপাশি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক আমার খোজ খবর নেন। আদালত তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ও পরে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি এ পাঠান । ৭ মাস জেল হাজতে থাকার পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জামিন পাই। জামিন পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে আত্মগোপনে থাকতে হয়। এ সময় আমার বাসায় ডিবি পুলিশ কয়েকবার হানা দেয়।
জামিন পেতে সার্বিক সহযোগিতা করেন চাঁদপুর জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক ভাই। এসময় রফিক মিজির বড় ভাই জাকির মিজি প্রশাসনিক তদবীর এর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে তাদের বাহির করার চেষ্টা করেন।
আয়না ঘরের সেই দুঃস্বহ স্মৃতি বলতে গিয়ে যুবদল নেতা রফিক মিজি এ সময় বারবার আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন । কারাগারে থাকা অবস্থায় জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, যুবদল কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল আমিন খান আকাশ, সাবেক জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম কাজী জুয়েল, সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম শফিকুর রহমান ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য এস এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক ছাত্রদল নেতা সামছুল আলম সূর্যসহ যারা খোঁজ-খবর নিয়েছেন সকলের নিকট চির কৃতজ্ঞ।
এ যুবদল নেতা বলেন, ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার এর আমলে ১১ টি মামলার দেয়া হয়।
সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের জন্য চাঁদপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গেইট এর সামনে থেকে ১৮ই জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় আটক করে পুলিশ। জুলাই আগষ্ট বিপ্লবে চাঁদপুর জেলায় সর্বপ্রথম আটককৃত ব্যক্তি জেলা যুবদল নেতা রফিক মিজি।
যুবদল নেতা রফিক মিজি জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছে আহ্বান জানান,ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়িত করবে তার দল।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫