প্রায় সাত হাজার ৭০৭ সন্তানহীন দম্পতিকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন তিনি। সফল হয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে। টেস্ট টিউবের মাধ্যমে সন্তানহীন দম্পতিকে গর্ভধারণ করানোর বিষয়ে সফলতা পেয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে। দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।
যার কথা বলছি, তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালের ফার্টিলিটি সেন্টারের অবসটেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজি কো-অর্ডিনেটর এবং জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মৃণাল কুমার সরকার।
মডার্ন ইনফারটিলিটি ম্যানেজম্যান্ট (আধুনিক বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনা) ও অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনিকস (আইভিএফ এবং এই সংক্রান্ত কার্যপ্রণালী) বিষয়ে তিনি বিশেষ দক্ষ। পাশাপাশি সব ধরনের ধাত্রী ও প্রসূতি বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ।
অনলাইন গনমধ্যমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন এ মাধ্যমে নিজের কাজ এবং বাংলাদেশে এই মাধ্যমের অবস্থা সম্পর্কে।
শুরুর গল্পটা
কেন এই মাধ্যমে কাজ করার ইচ্ছে হলো, এ প্রশ্নের জবাবে ডা. মৃণাল কুমার সরকার বলেন, ‘বন্ধ্যাত্ব এখনো এ দেশে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আসার পর দেখলাম ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব মানুষের মধ্যে আধা ঢাকা সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। বন্ধ্যা নারী বা বন্ধ্যা দম্পতির মধ্যে এক ধরনের সামাজিক জটিলতা কাজ করে। অনেকের মধ্যে এমন একটি ধারণা থাকে যে তারা যেন অপরাধ করেছে। স্বাভাবিকভাবে তারা বন্ধ্যাত্ব বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এ কারণে বেশির ভাগ সময় তাঁরা সুষ্ঠু চিকিৎসা থেকে অনেকটাই দূরে সরে থাকে। এতে স্বভাবতই তারা সুষ্ঠু চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় এবং সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। বন্ধ্যাত্বের কারণে অসংখ্য দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।’
‘অনেক সময় অনেক দম্পতি বা নারী প্রতারিত হয় অন্যের মাধ্যমে। এই বিষয়গুলো আমাকে বেশ ভাবাচ্ছিল। তখন সিদ্ধান্ত নিই তাদের জন্য কাজ করার।’
ডা. মৃণাল কুমার বলেন, ‘বন্ধ্যাত্ব যে চিকিৎসাযোগ্য আমাদের দেশে অনেকেই জানে না। অনেকেই মনে করেন এটি শুধু নারীর সমস্যা, যে কারণে অনেক পুরুষ একাধিক বিয়ে করেন। প্রকৃত অর্থে বন্ধ্যাত্বের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কিন্তু দায়ী হতে পারে। এসব ভেবেই আমার এই জায়গাটিতে কাজ করতে আসা। এই মাধ্যমে কাজ করতে এসে শুধু জীবিকা বা চিকিৎসা করা ছাড়াও পারিবারিক বন্ধন রক্ষায় অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।’
বেড়ে ওঠা
ডা. মৃণাল কুমার সরকারের জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ময়মনসিংহে। বিদ্যাময়ী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি, এরপর বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে তিনি ডিজিও সম্পন্ন করেন। এরপর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন থেকে ১৯৯৩ সালে এফসিপিএস (অবস/গাইনি) ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে ডা. মৃণাল কুমার সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সেন্টার ফর অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকশনের ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি সিঙ্গাপুরের কে কে আইভিএফ সেন্টারেও রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিন বিভাগে ফেলোর দায়িত্ব পালন করেছেন।
কাজ
ডা. মৃণাল কুমার সরকার বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ফার্টিলিটি শাখাটি বাংলাদেশে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কিছু কিছু টেকনোলজি থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না এই দেশে। চিকিৎসার এই শাখায় প্রশিক্ষণের তেমন সুযোগও ছিল না। ওই দশকের শেষের দিকে স্ত্রীরোগ বিভাগে কাজ করার সময় উপলব্ধি করি বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পিত বন্ধ্যাত্বরোধী ব্যবস্থা আনা প্রয়োজন। তখন ১৯৯৮ সালে আমি মুম্বাইয়ে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যাই। ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে কিছু কাজ করার পর আবার ভারতের কেরালার কোচিন শহরে পুনরায় প্রশিক্ষণে যাই।’
‘এরপর দেশে ফিরে কিছুদিন কাজ করার পর ২০০১ সালের প্রথমে মাদ্রাজে প্রশিক্ষণে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে প্রাথমিক কিছু কাজকর্ম খুলনা শহরে শুরু করি। তবে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বিশেষায়িত বন্ধ্যাত্ব সেবা দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ রকম অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ফেলোশিপের জন্য আমন্ত্রণ পাই। এই ফেলোশিপ সম্পন্ন করার সময় সিঙ্গাপুরে কে কে ওইমেন্স হাসপাতালে প্রজনন স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও কাজ করার সুযোগ পাই।’
‘প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৫ সালে দেশে ফিরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করার মানসিকতা নিয়ে যোগদানের জন্য যাই। পরে অবশ্য বিভিন্ন কারণে যোগ দেওয়া হয়নি। এরপর ২০০৫ সালের মার্চে অ্যাপোলো হাসপাতালের বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে যোগ দেই। অ্যাপোলো ফার্টিলিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করি। এই দলে বর্তমানে ১৩ জন কাজ করছে।’
ডা. মৃণাল বলেন, ‘অ্যাপোলো হাসপাতালের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত প্রযুক্তির সাথে প্রতিনিয়ত আপডেট করা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নিত্য ব্যবহার্য উপকরণ পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই সাফল্য অর্জন হয়েছে।’
‘যখন সন্তানহীন একটি দম্পতির সন্তান হয় তখন তাঁদের এই হাসি আমার জন্য অনেক বড় পুরস্কার। একজন সন্তানহীন দম্পতির জন্য সন্তান অত্যন্ত আনন্দের একটি অনুভূতি। যখন এ রকম কোনো দম্পতিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান জন্মদানে সহায়তা করে সফল হই সেটি আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।’
বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনায় মানুষ গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়
এই মাধ্যমের কাজ করতে এসে কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে জানতে চাইলে ডা. মৃণাল কুমার বলেন, ‘বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনায় মানুষ গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়। যখনই কোনো দম্পতি চিকিৎসককে আস্থাভাজন মনে করে তখনই সে তার ব্যক্তিগত তথ্য দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এটি একটি প্রতিবন্ধকতা। যখনই সে তথ্য খুলে বলতে চায় না তখন সমস্যা সমাধান আরো দুরূহ হয়ে পড়ে।’
‘এ ক্ষেত্রে আমরা স্বামী ও স্ত্রীকে আলাদাভাবে তাদের সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ দেই। একজন ছেলে বা মেয়ের এমন কিছু তথ্য থাকে যেগুলো কারো সাথে শেয়ার করা সম্ভব নয়। কিন্তু সব বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনায় এ রকম তথ্যাদি জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
‘আরেকটি বিষয়, অনেকেরই ধারণা বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। আসলে সেটি সত্য নয়। কারণ, সামান্য একটি উপদেশও বন্ধ্যাত্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রাখতে পারে।’
কাজটি কীভাবে করেন উত্তরে ডা. মৃণাল কুমার বলেন, ‘প্রথমত আমরা দম্পতিদের কাছ থেকে শুনতে চাই সন্তান ধারণের জন্য তারা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের সন্তান ধারণের মতো উপযুক্ত পরিবেশ ছিল কি না। এসব তথ্য এবং দাম্পত্য জীবনের ধরন চিকিৎসার বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে বন্ধ্যাত্বের কারণ নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আনুমানিক ৩০ শতাংশ দম্পতির বন্ধ্যাত্ব ব্যবস্থাপনার সঠিক উপদেশই যথেষ্ট। সামান্য সংখ্যক দম্পতি চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান ধারণে সক্ষম হয়। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দম্পতির ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।’
ডা. মৃণাল বলেন, ‘বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার নামে প্রতিনিয়ত অনেক মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে। অনেক নারী কবিরাজ বা ঝাড়ফুক করে এমন মানুষের কাছে যাচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এই প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা দরকার। অনেকেই জানে না বৈজ্ঞানিকভাবে এর চিকিৎসা সম্ভব।’
প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগ্রহ
বর্তমানে স্যারোগ্যাসি বা অন্যের জরায়ুতে বাচ্চা ধারণ করার বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বললেন, ‘সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন না থাকায় অনেক দম্পতি এই সেবা গ্রহণের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সুষ্ঠু সরকারি নিয়ম থাকলে দেশেই এই কাজ করা সম্ভব। সম্প্রতি আমরা গর্ভপূর্বক স্যারোগেসি চালু করছি,যার মাধ্যমে বিকলাঙ্গ সন্তান ধারণ বহুলাংশে কমানো সম্ভব।’
আমাদের দেশে ১৫ শতাংশ দম্পতি সন্তান ধারণে কিছু না কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রজনন স্বাস্থ্যে সাহায্য করা গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সম্ভব নয় জানিয়ে ডা. মৃণাল কুমার বলেন, ‘এই বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই বিষয়ে আরো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এই মাধ্যমে আরো ভালো কাজ করা যাবে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো রিসোর্স পারসন আমাদের দেশে এখনো কম। আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয় নিয়ে যারা আরো কাজ করতে চায় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগ্রহ রয়েছে আমার।’(এনটিভি)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট ৭:৩৫ পিএম, ০৪ জুন ২০১৬, শনিবার
এইউ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur