সিলভারের হরেক রকম পন্য বিক্রি করে সংসার চালান মোঃ আবুল কালাম (৫১)। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর বাজার এলাকায় বাসা ভাড়া করে থেকে বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন এভাবেই গ্রামগঞ্জে ঘুরে স্বল্প মূল্যে নানা প্রকারের পণ্য সামগ্রী বিক্রি করছেন। কাকা ডাকা ভোর হলেই প্রতিদিন বেরিয়ে পড়েন গ্রাামগঞ্জ ঘুরে স্বল্প মূল্যে নানা প্রকারের পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতে।
পরিবারে সুখের জন্য ৩০ বছর যাবত এ ফেরী কাজ করে আসছেন তিনি। টানা ১০ বছর যাবত ছেংগারচর পৌর এলাকায় এ ফেরী করে সিলভারের নানান প্রকারের পণ্য সামগ্রী বিবক্রির কাজে নিয়োজিত। আর এমন কর্মচাঞ্চল্যতায় চিরচেনা জীবন জীবিকার তাগিদে হরেক রকম ব্যবসার ভীরে সাফ্যল্যের মুখ দেখেছেন মোঃ আবুল কালাম (৫১)সহ চাঁদপুরের মতলবের ফেরীওয়ালারা।
শুক্রবার (১৩ জুন) এমন দৃশ্য দেখা যায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উজেলার ছেংগারচর পৌরসভার আদুরভিটি, ঠাকুরচর,বালচুর, ঘনিয়ারপাড়, কেশাইরকান্দি,শিকিরচর,বারোআনীসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
কথা হয় উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার এলাকায় কাঁধে বহন করে সিলভার ও স্টীলের ডেগ ডেগচি ও হাড়ি পাতিল বিক্রেতা মুন্সিগঞ্জের লৌহগঞ্জ থানার হাটবেগদিয়া এলাকার ফেরীওয়ালা ব্যবসায়ী পঞ্চাশোর্ধ আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি জানান, ৩০ বছর যাবৎ এ পেশায় রয়েছেন। আর টানা ১০ বছল যাবত ছেংগারচর পৌর এলাকায় ফেরী করে আসছেন স্ত্রী,সন্তান আর পরিবারে সুখের জন্য। তার প্রয়াত বাবা আবুল হোসেনও এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
প্রতিদিন ভোর হলে কাধে করে বের হয়ে পড়েন ৪০ কেজি ওজনের দুটি চাঙ্গারী নিয়ে। আর এই চাঙ্গারী গ্রামে গ্রামে গিয়ে সিলভারের হাড়ি, পাতিল, প্লাস্টিকের বাটি, ডালা, লবণদানি, বদনা, টুল,বটি, বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রী ফেরী করে বিক্রি করেন। হরেক রকমের নানা প্রকারের পণ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে চলছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। আর হাঁক-ডাক দিয়ে বলছেন ‘রাখবেন হরেক মাল, রাখবেন হরেক মাল। মা বোনদের কার কার লাগবে আপনারা দ্রুত চলে আসুন। দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে যান। বেলা হলেই কোথাও একটু বসে জিরিয়ে নিয়ে খাবার খাওয়া সেরে নেন।
আবুল কালামের মতো আরো কয়েকজন লাগবোনি গো হাড়ি পাতিল! আছেনি গো ভাঙ্গাচোরা প্লাস্টিক,বোহল, লোহা ভাঙ্গা, টিন রড ফিতা ? এমন সব ছন্দমাখা বাক্যে ফেরী ওয়ালার ডাকে মুখরিত এখন মতলবের গ্রামীণ জনজীবন। এদের ডাকে বাড়ির পুরুষরা কিছুটা বিরক্ত হলেও নারীরা কানপেঁতে থাকেন কখন আসবেন ফেরীওয়ালা। আর ঘরের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ক্রয় করবেন পুরনোটা ফেরত দিয়ে আর কিছু জমানো টাকা যোগ করে। আর এমন কর্মচাঞ্চল্যতায় চিরচেনা জীবন জীবিকার তাগিদে হরেক রকম ব্যবসার ভীরে সাফ্যল্যের মুখ দেখেছেন মুন্সিগঞ্জের লৌহগঞ্জ থানার হাটবেগদিয়া এলাকার আবুল কালাম, তার এলাকার প্রাং ১০-১২৩জনসহ মতলব উত্তরের কয়েক ফেরীওয়ালারা।
ছেংগারচর বাজারের ক্রোকারিজ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বাকীতে সিলভারে সিলভার কলস, জগ, বদনা, ভ্যারাটিস এসব মালামাল বিক্র করেন। বর্তমানে বিভিন্ন গ্রামে সাপ্তাহিক রুটিন করে বিক্রি করেন এসব মালামার। গুণগত মান ঠিক থাকায় তিনি এভাবে ছেংগারচর পৌরসভার প্রতিটি গ্রামের সফল ফেরীওয়ালা হিসেবে পরিচিত। বাজারের জাহাঙ্গীর এর কাছ থেকে ৫৫০ টাকা ধরে নিয়ে আর গ্রামে বিক্রি করেন ৬০০ – ৬৫০ টাকা। দৈনিক ২৫০০-৩৫০০ হাজার টাকা বেচা করতে পারলে। তার দৈনিক ১০০০- ১২০০ টাকা রেজগার হয়। এই ব্যবসায় কোনো চাঁদা, হয়রানি ছাড়া ব্যবসা করতে পারছি। এই অঞ্চলের মানুষ একটু শান্তি প্রিয়। ১০ বছর যাবৎ ব্যবসা করছি, তেমন কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি।
প্রথমে টাকার অভাবে বাজারে দোকান ঘর ভাড়া নিতে না পেরে স্বল্প পুজি নিয়ে এ পেশায় ফেরীওয়ালা হিসেবে যোগদেন। প্রথম বছরই গ্রামে গ্রামে গ্রাহক বা ক্রেতা পেয়ে যান। সাধারন দোকানে বাকি বিক্রি হওয়ায় পুজি সংকট ও অতি পুঁজির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফেরী করে ব্যবসায় বেশিরভাগই নগদ। তবে খুব পরিচিত হলে বাকি দেয়া হয়। এতে গ্রামের গৃহবধূদের কাছ থেকে একটু মুল্য বাড়িয়ে নেয়া যায়। হাটতে যদিও কষ্ট হতো প্রথম দিকে পরে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় শরীর আগের তুলনায় বেশি ভালো থাকে। আর এভাবে ফেরী ব্যবসা করে ৩ বিঘা জমি ক্রয় করে নতুন করে ঘর বাড়ি করে বড় ছেলে রকিবুলকে মালোয়েশিয়া পাঠিয়েছেন। মেয়ে ও ছোট ছেলে র্বমানে পড়াশুনা করে। স্ত্রী,দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার তার। জীবনে কষ্ট করেই গেলাম সুখ কি জিনিস তা বুঝলাম না।
আবুল কালাম জানান, এ ব্যবসায় বেচাকেনা ভালোই হয়। তার অধিকাংশ ক্রেতাই গ্রামের মহিলা। যারা কেনাকাটার জন্য বাজারে যায় না। তারাই তার কাছ থেকে নানা জিনিসপত্র কিনে থাকেন। অন্যান্য ব্যবসার মতো তাকেও খরিদদারদের বাকি দিতে হয়।
তিনি আরো বলেন, মুন্সিগঞ্জ জেলা থেকে প্রতি বছর চাঁদপুরের মতলব উত্তরে আসি হরেক রকম পণ্য বিক্রি করতে। আমার মত বেশ কয়েক জন এ ব্যবসায় জড়িত। বছরের কয়েক মাস এ কাজে জড়িত থাকি অন্য সময় বাড়ি কৃষি কাজ করি। এই ব্যবসায় কোনো চাঁদা, হয়রানি ছাড়া ব্যবসা করতে পারছি। এই অঞ্চলের মানুষ একটু শান্তি প্রিয়। ১০ বছর যাবৎ ব্যবসা করছি, তেমন কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি।
জীবিকার প্রয়াজনে অন্য জেলায় বাড়ি হলেও রূপসায় বাসা ভাড়া নেন। বর্তমানে হরেক মালের ব্যবসায় নেমেছেন হয়রতসহ অনেকেই। আবুল কালাম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহগঞ্জ থানার হাটবেগদিয়া গ্রামে তার বাড়ি।
গত ১০ বছর এ উপজেলায় বাসা ভাড়া থেকে বিভিন্ন গ্রামে ফেরি করে মালামাল বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছি। আমার দুই কার্ধে কালো দাগ পর্যন্ত পড়ে গেছে এই চাঙ্গারী টানতে টানতে। কিন্তু বতর্মান তেমন কেনা বেচা না থাকায় কষ্টের মধ্যে আছি। যেভাবে সব জিনিসের নাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বেচে থাকা কষ্টের হয়ে পড়েছে। তবে তার মনে সুখ যে তিনি স্ত্রী,সন্তান পরিবারের জন্য নিজে পরিশ্রম করছেন। এই পেশায় সত্য পথে উপার্জন করে তার ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা করে সত্যিকারের মানুষ হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হবে এটাই তার আশা।
উপজেলার ছেংগারচর বাজারের ষাটোর্ধ পাইকারী ব্যবসায়ী মোঃ শাহজালাল বলেন এক সময় ফেরীওয়ালা ছিলাম আমিও। সম্পদ বলতে কিছুই ছিলো না আমার। গাউছিয়া থেকে ৫ হাজার টাকার সিলভার পাতিল ও স্টীলের থালাবাসন নিয়ে ফেরী করে বিক্রি শুরু করি। এভাবে ৭ বছর সফলতার সাথে ব্যবসা করে এখন ছেংগারচরা বাজারে আমার সবচেয়ে বড় দোকান । সততার সাথে ব্যবসা করে ভালো মুনাফা আসে। আর ফেরী করে ব্যবসা যারাই করেছে তারা সবাই সফল হয়েছে। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় লোকজন ফেরী করে ব্যবসা করতে লজ্জা পায় । এতে বেকার হয়ে পড়ে থাকে। মাদক ও জুয়ায় জড়িয়ে যায়। কাজকে কখনো ছোট করে দেখতে নেই। যারা কাজকে অবমুল্যায়ন করবে তারা কখনো বৈধ ব্যবসায় সফলতা পাবে না।
পণ্য কিনতে আসা পৌর এলাকার আদুরভিটি গ্রামের জান্নাতি বেগম জানান, হাতের কাছে কম দামী জিনিস পেয়ে বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় হরেক রকম পণ্য ক্রয় করলাম। আমি সহ গ্রামের মহিলারা হাতা,চুলের ক্লিপ,হাঁড়ি, নেলপালিসসহ, ঘরের ব্যবহারিক ছোটখাটো জিনিস পত্র ক্রয় করি।
উপজেলার কেশাইরকান্দি এলাকার গৃহীনি ফেরদৌসী বলেন, গৃহস্থালী অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যস্ততার কারনে হাট-বাজারে যাওয়া সম্ভব হয় না। এসব প্রয়োজনীয় পণ্যই ফেরীওয়ালারা ডেকে ডেকে বিক্রি করেন। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য সাশ্রয়ী । তিনি আরো বলেন, কাঙ্খিত পণ্য ফেরীওয়ালাদের ঝুড়িতে না থাকলেও তাদের মাধ্যমে অর্ডার করা যায়।
এসব বিষয়ে ছেংগারচরন বাজার ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর সওদাগর বলেন, আমি আবুল কালামসহ এমন ১০-১২জনকে বাকিতে সিলভারের নানান ধরণের পণ্য সামগ্রী দিয়ে দিয়ে থাকি। তারা ফেরী করে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করে সেই টাকা প্রতিদিনেরটা পরিশোধ করেন। অনেক মহিলারা বাজাওে ব্যস্তার জন্য বাজারে আসতে পারেন না। বিশেষ করে মহিলাদের পছন্দ হলো দেখে যাচাই বাচাঁই করে ক্রয় করা। এ হিসেবে ফেরীওয়ালাদের কাছ থেকে এ সুবিধা তারা পেয়ে থাকে। এ কারণে এলাকায় বহু ফেরীওয়ালার ভাগ্য বদলাতে দেখেছি। এদের মাঝে যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে ছেংগারচর পৌরসভায় বসবাস করতো। এখন তাদের নিজের মালিকানায় বাড়ি রয়েছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক,১৩ জুন ২০২৫