বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) চাঁদপুর সদর উপজেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটছে। বিগত প্রায় এক দশক সময়ে এই কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ হয়। ঘটনায় জড়িত একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকলেও উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দাপ্তরিকভাবে অভিযুক্ত করা হয় একজন কর্মচারীকে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বিমায় আর্থিকভাবে দুর্বল করতে একের পর এক পরিচালকরাই ভূয়া ঋণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ লোপাটের স্বর্গ রাজ্য বানায়। এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা বিআরডিবি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীও দীর্ঘদিন ধরে সমিতির বিভিন্ন খাত থেকে সুকৌশলে অর্থ লোপাট করার অভিযোগ অনুসন্ধানে উঠে আসে।
অনুসন্ধানে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, আর্থিক লুটপাটে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায় সদর উপজেলা বিআরডিবি অফিসের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষক মো. আবদুল গণি, সাবেক হিসাব রক্ষক মো. আবুল কাশেম খান, সহকারী হিসাব রক্ষক আফরোজা বেগম ও মাঠ সংগঠক মো. ইকবাল বাহারের বিরুদ্ধে। একই সাথে আর্থিক এই দুর্নীতির সাথে কমবেশি জড়িত ছিলেন পরিদর্শক মো. মঞ্জুর আহম্মেদ, অফিস সহায়ক হোসেন শেখ, নৈশ প্রহরী খোকন পাটোয়ারী এবং অফিস সহায়ক আমেনা বেগম।
দীর্ঘ বছর এই আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও জড়িতরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাপ্তরিক কোন অভিযোগ করেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর এই বিষয়ে বিআরডিবির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, হিসাব রক্ষক আবদুল গণি ও সহকারী হিসাব রক্ষক আফরোজা বেগম পরস্পর স্বামী-স্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম খান তাদের নিকট আত্মীয়। এই তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশের মাধ্যমে মাঠ সংগঠক মো. ইকবাল বাহারকে ব্যবহার করে শেয়ার, সঞ্চয়, ঋণ, সেবা মূল্য আদায় বাবদ মোট ৪২ লাখ ৮২ হাজার ১৭৮ টাকা আত্মাসাৎ করেন।
দীর্ঘ দিন ধরে তার সংস্থার ব্যাংকের হিসাব নম্বরে টাকা লোপাট করলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনি। গত ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ সঞ্জয় দাস সদর উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্ত হিসেবে যোগদান করলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষক মো. আবদুল গণি, সাবেক হিসাব রক্ষক মো. আবুল কাশেম খান, সহকারী হিসাব রক্ষক আফরোজা বেগম ও মাঠ সংগঠক মো. ইকবাল বাহারসহ পরিদর্শক মো. মঞ্জুর আহম্মেদ, অফিস সহায়ক হোসেন সেখ, নৈশ প্রহরী খোকন পাটোয়ারী এবং অফিস সহায়ক আমেনা বেগমের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে।
লুটপাটকৃত টাকা উদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যেগে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটির আহবায়ক সহকারী পরিচালক মনিটরিং মো. মাহফুজ আলম, সদস্য মতলব উত্তর উপজেলা সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সরকান ও হিসাব রক্ষক (নিরিক্ষা শাখা) মো. আল আমিন। বিআরডিবির প্রধান কার্যালয় থেকে ২৮ অক্টোবর এই ঘটনায় নোটিশ করা হয়। পরদিন ২৯ অক্টোবর সরেজমিন তদন্ত হয়।
তদন্ত টিম দায়িত্ব পালনকালে অভিযুক্তদের পরস্পরের যোগসাজশের বিষয়টি চিহিৃত এবং স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুল গণি, সাবেক হিসাব রক্ষক মো. আবুল কাশেম খান, সহকারী হিসাব রক্ষক আফরোজা বেগমের আত্মীয়তার পরিচয়টি উঠে আসে। এছাড়া তারা পতিত আওয়ামী লীগ ফ্যসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে সদর উপজেলা বিআরডিবি কর্যালয়কে ত্রাসের রাজ্যে পরিণত করেন।
এছাড়া এই অফিসে যোগদানের পর থেকে মো. আবদুল গণি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত। একই সাথে মো. আবুল কাশেম খান ২৩ বছরের অধিক সময় ধরে চাঁদপুরের বিভিন্ন অফিসে চাকুরি করেন এবং সহকারী হিসাব রক্ষক আফরোজা বেগম তাদের আত্মীয়-স্বজন হওয়ায় পরস্পরের মাধ্যমে মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহারকে ব্যবহার করে আর্থিক দুর্নীতিতে জড়ায়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহার জানান, আমি ফেনী জেলার বাসিন্দা। চাঁদপুর সদর উপজেলা বিআরডিবি অফিসে মাঠ সংগঠক হিসেবে যোগদান করি। আমার উর্ধ্বতন হিসেবে যারা ছিলেন প্রত্যেকেই স্থানীয় সদর উপজেলার বাসিন্দা ও সরকার দলীয় লোকজন হওয়ায় আমাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে অর্থ কেলেংকারির সাথে জড়িত করে। তবে আমার কাছে বিআরডিবি যে টাকা আছে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিআরডিবির নির্দিষ্ট হিসাব নম্বরে জমা দিয়ে দিবো।
এদিকে হিসাবরক্ষক মো. আবদুল গণির দাবি মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহার সেচ্ছায় অর্থ লোপাট করে। কাউকে কাউকে ধার দেনা দেয়।
সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসরে যান সদর উপজেলা সাবেক ভারপ্রাপ্ত পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম খান। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহারের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার এই বিষয়ে আমি নিজে দায়িত্বরত অবস্থায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। তবে এই আর্থিক অনিয়মে তিনি নিজেও জড়িত রয়েছেন বিষয়টি অস্বীকার করেন।
প্রতিবেদক: মুসাদ্দেক আল আকিব,১৮ মার্চ ২০২৫
ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রথম পর্ব। চলবে…