চাঁদপুরে নতুন ভূমি আইনে প্রথম রায়: বসতভিটা জবরদখলে দুই বছর কারাদণ্ড

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার বাড়ৈগাঁও গ্রামে বসবাসরত কৃষি উদ্যোক্তা মো. হাবিবুর রহমানের জমি জোরপূর্বক দখল করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে আদালত নতুন প্রণীত ভূমি অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধ আইন, ২০২৩-এর আওতায় প্রথম দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছেন। গত ২০ এপ্রিল চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট-০১ এর বিচারক ত্বন্ময় কুমার দে এই রায় ঘোষণা করেন।

আসামি তাজু পাটোয়ারীকে নতুন আইনের ৭(২) ও ১০ ধারায় এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
তবে, তাজুর স্ত্রী জেসমিনকে মামলার সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।

বাদী হাবিবুর রহমান জানান, গত ৫/৫/২০২৩ ইং তারিখে আসামিরা তার নিজস্ব বসতভিটার মধ্যে তাজু পাটোয়ারী জোর করে প্রবেশ করে হাবিবুর রহমানের নির্মানাধীন ভবনের তিনটি বেইজ গর্ত করে আসামীদের বেইজ ঢালাই করে পিলার নির্মাণ করেন এবং দুটি জানালা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে দেন। তারিখ ১৯ মে থেকে টানা তিনদিন ২১/০৫/২০২৩ পর্যন্ত উভয়পক্ষের একজন করে দুইজন সার্ভেয়ার সীমানা নির্ধারন করেন, যেখানে দেখা যায় আসামিরা পূর্ব পশ্চিম ১৭৩ ফুট লম্বা সীমানার অন্দরে ৩০ লম্বা এবং ৬ ফিট পাশে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করে বিল্ডিং এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে দুই পক্ষের সারভেয়ার, মেইনম্যান, উভয় পক্ষ এবং এলাকার উপস্থিত স্বাক্ষীদের স্বাক্ষরিত একটি অনাপত্তি ট্রেসিং/স্কেসম্যাপ ঘোষনা করা হয়, যাহা আদালতের নথিতে ফিরিস্তি আকারে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আসামিরা অনাপত্তি স্বাক্ষর করার পরও জোরপূর্বক কাজ চালিতে যেতে থাকে। ০৭/০৬/২০২৩ তারিখে বাদী আদালতের আশ্রয় নেয় এবং বিজ্ঞ আদালত ১৪৫ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যখন ঘটনার সময় আদালতের ১৪৫ ধারায় নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল, তবুও তা উপেক্ষা করে নির্মাণকাজ চালানো হয়।

আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারায় মামলা রুজু করে, এবং নালিশি ভূমিতে বিজ্ঞ আদালত মতলব দক্ষিণ থানা ওসিকে ‘রিসিভার’ নিয়োগ করে এবং পরবর্তীতে ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ইং তারিখে বাদী ভূমি অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধ আইন, ২০২৩ অনুযায়ী সি.আর. ৩৫/২০২৪ (মতলব দক্ষিন) মামলাটি দায়ের করেন।

বাদী পক্ষ আদালতে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনও (আদালতের আদেশ অমান্য করে মতলব দক্ষিনে কৃষি উদ্যোক্তার ভূমি বেদখলের পায়তারা” শিরোনাম) দাখিল করেন, যাতে ঘটনাটি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হয়।

এই মামলায় চাঁদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিথিলা রানীর নির্দেশে (৪ জানুয়ারি ২০২৪) পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) সরেজমিন তদন্ত করে এবং বাদীর পক্ষে সঠিক প্রতিবেদন বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করে, যেখানে আসামির জোরপূর্বক প্রবেশ ও নির্মাণ কার্যক্রম প্রমাণিত হয়।

আদালত আসামিকে ৪(১)(ক), ৭(১)(২), ৮ ও ১০ ধারাতে অভিযুক্ত করেন। তবে শাস্তি নির্ধারণ করা হয় ৭(২) ও ১০ ধারা অনুযায়ী—এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড)।
আসামিকে ৪(১)(ক), ৭(১), ও ৮ ধারায় খালাস দেওয়া হয় এই মর্মে যে, এসব ধারায় বিচার করার এখতিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নয়।

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল বাশার (জেলা জজ আদালত, চাঁদপুর) বলেন, আসামি তাজু পাটোয়ারী হাবিবুর রহমানের বাড়িতে জোর করে প্রবেশ করে তিনটি পিলার নির্মাণ করেন, যার ফলে দুটি জানালা অবরুদ্ধ হয়। এটি শুধু জমি দখল নয়, বরং তার বসবাসের পরিবেশ, আলো-বাতাস, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ।

আইনের ভাষায় ‘ব্যবস্থাপনা’ বলতে বোঝায়—বাড়ির আলো-বাতাস প্রবাহ, চলাচল সুবিধা, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা। আসামির নির্মাণে সেই বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়ে, এবং আদালতে দাড়িয়ে আসামী বাদীর জায়গাকে নিজের বলে দাবি করে, যা ৪(১)(ক) ধারা অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হওয়া উচিত ছিল। আমরা রায়ের এই অংশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।”

কৃষি উদ্যোক্তা মো. হাবিবুর রহমান, যিনি ২০১৪ সাল থেকে ভার্মি কম্পোস্ট/জৈব সার উৎপাদন ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে সক্রিয়, বলেন, আমি দেশপ্রেমিক একজন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করছি। অথচ নিজের ঘরের মধ্যেই জবরদখলের শিকার হয়েছি। আদালতের এই রায় প্রাথমিক ন্যায়ের প্রতীক, তবে আমি চাই এই অবৈধ নির্মাণ দ্রুত উচ্ছেদ হোক এবং প্রশাসন কঠোর ভূমিকা নিক।

এই রায়কে চাঁদপুর জেলার ইতিহাসে ভূমি অপরাধ আইনের প্রথম কার্যকর রায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আইন সচেতন মহল মনে করেন, এটি সমাজে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—জবরদখল, অবৈধ নির্মাণ ও বসতভিটার হস্তক্ষেপ আর কোনোভাবেই সহ্যযোগ্য নয়। রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, ভূমির সুরক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন আইন প্রয়োগে সরকার ও আদালত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

প্রতিবেদক: শরীফুল ইসলাম, ২৭ এপ্রিল ২০২৫