Home / ফিচার / সাংবাদিকতায় নগ্নতা-সমাজ-সভ্যতা
সাংবাদিকতায় নগ্নতা-সমাজ-সভ্যতা

সাংবাদিকতায় নগ্নতা-সমাজ-সভ্যতা

গত ১ মার্চ রাজধানীতে একটি তুচ্ছ ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে বসুন্ধরা গ্রুপের নিরাপত্তা কর্মীরা পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করার পর বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করে এবং কয়েকটি স্থানে ভাঙচুর করে।

এ ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন সব ক’টি গণমাধ্যম বিশ্ববিদ্যালটির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গায়ে গণহারে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশ করে।

এরই মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যে সংবাদ থেকে দূরে সরে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তাদের প্রকাশিত এবং প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে কোন ছাত্রের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

এসব শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররাও বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচী দেবে না। পুলিশের মধ্যস্থতায় শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।

আর এই বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোই প্রমাণ করে দেয়, দেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিজ স্বার্থে নিজের গণমাধ্যমগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ওই ছাত্রদেরকে কীভাবে সুকৌশলে জঙ্গি বানিয়ে দেবার অপকৌশল চালাচ্ছিলো।

কিন্তু সাধারন ছাত্রদেরকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের সময় বসুন্ধরার মিডিয়া গ্রুপের বিজ্ঞ সাংবাদিকরা কি একবারের জন্যও ভাবলেন না, যাদের বিরুদ্ধে এমন ভয়ানক অপবাদ দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে তাদের জীবনে, তাদের পরিবারের ভাগ্যে কী ভয়াবহ দুঃসময় নেমে আসতে পারে!

আরো অবাক হওয়ার বিষয়, যে সব বিজ্ঞ সাংবাদিক সাংবাদিকতার নীতিমালা বা নীতি নৈতিকতা নিয়ে প্রায়শই বিভিন্ন টকশো কিংবা পত্রিকার কলামে ছবক দেন তারা এই ঘটনার প্রতিবাদে কিছু বললেন না, একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না সাংবাদিক নেতারা!

বিশেষ বিশেষ ওই দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টালগুলোর এই চরম হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে জোরালো কোন সংবাদ দু-একটি অন লাইন পত্রিকা ছাড়া আর কোন গণমাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচার হলো না। কোন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকেই সংশ্লিষ্ট সংবাদ মাধ্যমগুলোর দায়িত্বশীল কারোর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা হলো না, সাধারন ছাত্রদের গায়ে ‘জঙ্গি’র মতো একটি ভয়াবহ শব্দ কেনো এভাবে লাগানোর অপচষ্টা করা হলো?

‘কেনো হলো না?’ এমন একটি প্রশ্নের উত্তর হতে পারে একাধিক। তবে তার কোনটিই যে ন্যুনতম যুক্তিসঙ্গত হবে না, এ কথা দ্বার্থহীন কন্ঠে বলা যায়।

এক্ষেত্রে বসুন্ধরার মিডিয়া গ্রুপের সঙ্গে অন্যান্য গণমাধ্যমের পার্থক্য রইলো কোথায়? হ্যাঁ, একটি পত্রিকা অবশ্য অনেকটা জোরালোভাবে বসুন্ধরার মিডিয়া গ্রুপের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেছে। সেটির নাম ‘মানবকন্ঠ’। মজার বিষয় হচ্ছে, এই পত্রিকাটি আশিয়ান গ্রুপের।

শোনা যায়, ব্যবসায়ীক কারণে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। অর্থাৎ যে যার স্বার্থে আত্মনিমগ্ন থেকে কার্যসিদ্ধিতে ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে পুলিশের যে সতর্ক ভূমিকা, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।

দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি সরকারের রক্তচক্ষুর সামনে কাজ করতে হচ্ছে আমাদের গণমাধ্যমকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে কোন বক্তব্য সামনে এলেই তার প্রতিবন্ধক হিসেবে অভিযোগের আঙুলটি প্রথমে ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে।

কিন্তু গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং মালিকপক্ষ কি সরকারের চেয়ে কোন অংশে কম দায়ী এক্ষেত্রে? গত বছর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বঙ্গবন্ধু মিডিয়া কমপ্লেক্সে’-এর উদ্বোধন করতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এজন্যই বলেছিলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চেয়ে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা বেশী জরুরি।

কেনো গণমাধ্যমের এই দৈন্যতা? উত্তরটা মেলানো খুব কঠিণ কিছু নয়। সবই পুঁজির খেলা। গণমাধ্যম এখন আর প্রকৃত সাংবাদিকদের হাতে নেই।

আর একটি বিষয় হলো, সাংবাদিকরা এখন যেনো সব শ্রেণী, পেশার মানুষের অভিন্ন শত্রু। কিছু হলেই দোষ সব সাংবাদিকের। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্রদেরকে নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চরম অনৈতিক এবং হিংসাত্বক অপসাংবাদিকতার বিষয়েও সবাই ঢালাওভাবে গালমন্দ করছেন পুরো সাংবাদিকক সমাজের। এতে লাভ কী?

রাজনীতিবিদ, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি রাষ্ট্রের চতূর্থ স্তম্ভ ‘গণমাধ্যম’। এইসব গণমাধ্যমে যেসব অভিজ্ঞ এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক উপরের কাতারে কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই উঠতে পারছেন না ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে। আবার তাদের অথবা মালিক পক্ষের নির্দেশ মানতে গিয়ে যেসব নবীন সাংবাদিকককে মাঠে হলুদ সাংবাদিকতায় নামতে হচ্ছে তাদের পেটে রয়েছে ক্ষুধা।

চাকরি ছাড়া গত্যন্তর নেই। এর বাইরে যারা ব্যক্তি স্বার্থে হলুদ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে টিকে আছেন বীরত্বের সঙ্গে তাদের সংখ্যাও কম নয়। এসবে প্রতিবাদ করার সাহস রয়েছে খুবই অল্প সংখ্যক আদর্শবান সাংবাদিকের। তবে প্রতিবাদী সাংবাদিকের সংখ্যা কম হলেও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেয়া সাংবাদিকের সংখ্যা এখনও অনেক বলে আমার বিশ্বাস।

সাংবাদিকতার এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে তারপরও বলবো, এটিই একমাত্র পেশা যেখানে প্রকৃত সাংবাদিকরা নিজ পেশার সমালোচনা করেন প্রকাশ্যে। তাদের অনুসন্ধানী চোখে পুরো পৃথিবীকে দেখার অদম্য বাসনা বিশ্ববাসীর।

বুকের বিশ্বাস থেকে তারপরও বলবো, ওই আদর্শবান সাংবাদিকরাই যুগে যুগে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন একটি সত্যিকারের মানবিক সভ্যতার পথে।

মঞ্জুরুল আলম পান্না : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
monjurpanna777@gmail.com

Leave a Reply