Home / ফিচার / সমাজ কে, সমাজ কী, মনের হদিস কে রাখে?
সমাজ কে, সমাজ কী, মনের হদিস কে রাখে?

সমাজ কে, সমাজ কী, মনের হদিস কে রাখে?

শিশুরা হলো সাদা কাগজের মতো, এই কাগজে সমাজ যেভাবে আঁচড় কাটে, পরবর্তীসময়ে তারই মতো করে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইমের এই মতবাদ স্পষ্ট ভাবে আঙ্গুল তুলেছে সমাজের প্রতি।

তবে কি সমাজই শিশুকে করে তুলেছে অপরাধপ্রবণ নাকি সামজের আঁচড়গুলো ক্ষতবিক্ষত করছে শিশুর মনকে প্রতিনিয়ত, যার ফলে শিশুর কোমল মনের আঘাত জন্ম দিচ্ছে কোনো অপরাধ।

এ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে সমাজ কে? সমাজ কী? আমরা-শিশুর বেড়ে ওঠার সকল অনুষঙ্গ যোগাবার দায়িত্বে যারা, শিশুর জীবনপটে পারিপার্শ্বিকতার ছবি আঁকার উপকরণ বা রসদ মেটানোর লক্ষ্যে নিয়োজিত যারা, আর শিশুর সঙ্গী হয়ে তার অবধারণ জগতে অনুধাবনের কৌশল শেখাই যারা তারাই মিলে সমাজ।

কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এই অনুষঙ্গ, উপকরণ বা সঙ্গী কী বা কারা। আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে নিঃসন্দেহে শিশুর জীবনের অনুষঙ্গ বা উপকরণের যে নামটি প্রথমেই উচ্চারিত হবে তা হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যমই যদি আমাদের শিশুর জীবনে আঁচড় কেটে চলে তবে আমরা কোথায়?

কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোর আলোচনার বিষয়বস্তুর নামকরণ করা হয় ‘সন্তান যখন ঘাতক’ নামটি দেখেই মনে পড়ে যায় ঢালিউডের ‘বাবা কেন চাকর’ কিংবা ‘স্বামী কেন আসামী’ মার্কা চটুল জনপ্রিয় সিনেমা। কিন্তু একবারও কি প্রশ্ন জাগে না যে এই নাম একটি শিশুর মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে। সন্তান কখনোই ঘাতক হয়ে ভূমিষ্ঠ হয় না বরং নিষ্পাপ শিশু সন্তানটি পরিবার পারিপার্শ্বিকতার রূঢ় বাস্তবতায় বিপথগামী হয়ে অপরাধ জগতে পা বাড়াতে পারে।

এক ঐশীর ঘটনা যখন সকল সন্তানকে ঘাতক বলে আখ্যায়িত করার অপপ্রয়াস চালায়, তখন ছোট শিশুর ‘ঘাতক কী’ প্রশ্নে থমকে যেতে হয় মাকে। কিংবা গণমাধ্যমে যখন হরহামেশাই সহিংস ঘটনা উপস্থাপিত হয় কোনোরূপ বাছবিচার ছাড়া, তখন শিশু দর্শক পুরো সমাজকেই সহিংস-অপরাধপূর্ণ, মারামারি কাটাকাটি বলে ভাবতে শিখে। চোখের সামনে দিনের পর দিন রক্ত, লাশ দেখে কেউ কেউ যেমন কুকড়ে যায়, তেমনি আবার কারও কাছে বিষয়টি গা সওয়া স্বাভাবিক মনে হতে শুরু করে। উভয় পরিস্থিতিই শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্তরায়। প্রতিটি শিশুই যেহেতু অনন্য তাই প্রত্যেকেই গণমাধ্যমের বার্তার প্রতি ভিন্নভাবে সাড়া দিবে। কিন্তু গণমাধ্যমের যে বার্তা শিশুর জন্য হওয়াই উচিত নয়, সেই বার্তা শিশুর মনোজগতে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এ তো গেল গণমাধ্যম তথা টেলিভিশনের প্রকোপ। আজকের বাস্তবতায়, শিশু বল বা গাড়ি দিয়ে খেলার চেয়ে ট্যাব বা স্মার্ট ফোনে খেলতে বেশি ভালোবাসে। শিশুটি খেলে ‘জোমবি’, ;ফ্রুট নিনজা’ আরো কত কি। এসব খেলা শিশুকে একরকম সহিংস আচরণের প্রতি আন্দোলিত করতে পারে। কারণ এসব খেলায় ব্যবহৃত রং, শব্দ এবং দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

উদ্দীপক ক্রিয়াফল তত্ত্বের প্রবক্তা লিওনার্ড বারকোইটজ গণমাধ্যমের সহিংস দৃশ্যের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এসকল দৃশ্য দর্শক-শ্রোতাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে উত্তেজিত করে। ফলে তাদের মধ্যে সহিংস আচরণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ট্যাব বা স্মার্ট ফোনের খেলাগুলোর প্রভাব নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তত্ত্ব হাজির না হলেও গণমাধ্যমের বহু তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে।

অপরপক্ষে নগরজীবনের বাস্তবতায়, বাবা-মায়ের ব্যস্ততায় বহু শিশুই বঞ্চিত হয় সহোদর থেকে। একাকীত্বের জীবনে শিশুটির লালন-পালনের এক গুরু দায়িত্ব পড়ে হয়তো গৃহকর্মীর ওপর। কারণ আধুনিক জীবনযাত্রায় একান্নবর্তী পরিবারতো সেকেলে তাই একক পরিবারের ছিমছাম চৌহদ্দীতে ঠাঁই মেলে না বহু আপনজনের। আর হাল ফ্যাসনের হাওয়ায় ভেসে চলে শিশুর নিঃসঙ্গ বেড়ে ওঠা। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের বার্তার ভুল ব্যাখ্যা বা ত্রুটিপূর্ণ অনুধাবন শিশুর মনস্তত্ত্বকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি বাবা-মার কর্মব্যস্ত জীবন সন্তানের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে প্লেটো বলেছিলেন ‘nature is more important than nurture’.শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও শৈশবের অভিজ্ঞতা তার পরবর্তী জীবনকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। আর ফ্রয়েডের মতে চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই শিশুর ব্যক্তিত্বের কাঠামো তৈরি হয়ে যায় এবং সারাজীবন সে আদলেই চলে। প্লেটো এবং ফ্রয়েডের বক্তব্যকে যদি সত্য বলে মেনে নেই, তবে আমাদের সন্তানেরা হয়ে উঠছে সমাজবিচ্ছিন্ন, সঙ্গ বিবর্জিত, গণমাধ্যম কেন্দ্রিক এক ব্যক্তিত্ব। সে বাস্তবতা দেখে টেলিভিশন স্ক্রিনে, কথা বলে ট্যাবের টকিং টমের সাথে আর সময় কাটায় কতোগুলো চৌক বাক্সের সাথে-যা কখনো ছোট আবার কখনো বড়।

যান্ত্রিক জীবনে আমাদের সন্তানেরাও যন্ত্র হয়ে উঠবে অথবা আবেগহীন, ভালোবাসার সঙ্গবিহীন শৈশব কাটাবে তা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। এই অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজন অভিভাবকদের জীবনচারণের পরিবর্তন। জীবনের চাহিদা পূরণে সদা ব্যস্ত মা-বাবাও পারেন দিনের খানিকটা সময় সন্তানের সাথে অতিবাহিত করতে। তবে এ যেন কেবল সময়ক্ষেপণ বা শাসনের প্রহর না হয়ে ওঠে বরং আমরা যদি বন্ধুসুলভ আচরণের মধ্য দিয়ে সন্তানের সাথে ভালো কিছু সময় কাটাই, তবে শিশুটির বাবা-মার প্রতি মানসিক দূরত্ব দূর করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সেই ভালো সময়টির জন্য শিশুটি অপেক্ষা করবে বলে বাবা-মায়ের প্রতিও একরকম টান সৃষ্টি হবে।

আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা থাকা উচিত কর্মক্ষেত্রে থাকার সময়ে আমাদের শিশুটি যেন কেবলমাত্র গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে না থাকে। পরিবাবের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছে আমাদের প্রয়োজন যাই হোক না কেন সন্তানের মঙ্গলার্থে আমাদের নিকট তাদের প্রয়োজন অনেক। অন্যদিকে শিশুর মূল্যবোধ বিশ্বাস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুর অভাব-অভিযোগ বন্ধ করার জন্য কিংবা শিশুকে শান্ত বা তুষ্ট রাখার জন্য যেন শিশুর হাতে অত্যাধুনিক কোনো ডিভাইস তুলে না দেই। এতে কেবল শিশুর শারীরিক ক্ষতিই নয় বরং মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে। এর পরিবর্তে শিশুর উপযোগী বই তুলে দিতে পারি তার হাতে। তার জীবনচারণের অনন্য ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে বই পড়া। অন্যদিকে শিশুর টেলিভিশন দেখার ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের আধেয় বাছাইয়েও আমাদের হতে হবে যত্নশীল এবং কখনো কৌশলী। সন্তানকে জীবন দর্শন শেখানোর জন্য আমরা সাহায্য নিতে পারি সিনেমার। এমনকি সন্তানের সাথে বসে সিনেমা দেখার মধ্য দিয়েও শিশুর শিক্ষা, আচরণ-অবধারণের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারি আমরা।

সর্বোপরি শিশুর সাথে যথাসম্ভব বেশি মাত্রায় যোগাযোগ করতে হবে, সরাসরি সম্ভব না হলে বারবার টেলিফোনে হলেও যোগাযোগ করতে হবে এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই সন্তানকে স্পর্শ করতে হবে। প্রয়োজনে অপ্র্রয়োজনে করা এই স্পর্শ সন্তানকে তার পরবর্তী জীবনে করে তুলতে পারে স্নেহ মমতায়পূর্ণ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে শিশুর জীবন গঠনে স্পর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। বাবা-মা নিজেদের শিশুর জন্য আদর্শ ব্যক্তিত্বরুপে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালাবেন। বাবা-মা যদি শিশুর চোখে সুপারম্যান/সুপারওম্যান হয়ে উঠতে পারেন তবে একদিকে যেমন শিশু নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, তেমনি তার আচার- আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আদর্শ, ব্যক্তিত্ব সর্বক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের শিশু ‘বনসাই’ নয় বরং হয়ে উঠবে বিশাল বটবৃক্ষ।

(লেখক, শবনজ আযীম : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
: আপডেট ১:০৬ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ