Home / বিশেষ সংবাদ / ‘মনে করেছিলাম জামাইয়ে চাকরি করে, এখন দেখি মাস্টারি করে’
‘মনে করেছিলাম জামাইয়ে চাকরি করে, এখন দেখি মাস্টারি করে’

‘মনে করেছিলাম জামাইয়ে চাকরি করে, এখন দেখি মাস্টারি করে’

শিক্ষকতা বা তথাকথিত মাস্টারি পৃথিবীর একটি অতি অাদি পেশা ৷ কেউ এ পেশাটাকে অামাদের দেশে ছোট করে দেখে অাবার কেউ বা সম্মানি পেশাও বলে থাকে ৷ যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাদের এ কাজটিকে সমাজে মাস্টারি করা হিসেবেই দেখে থাকেন ৷ তবে অামরা যারা শিক্ষকতা করি অামারা পেশাটাকে শুধু চাকরি হিসেবেই দেখছি না অামাদের ঘাঁড়ে জাতির একটি গুরু দায়িত্ব হিসেবেই ভাবছি ৷

অাবার সমাজের কেউ কেউ বলে থাকেন, যারা কোন চাকরি পায় না তারাই মাস্টারি করে৷ মাস্টরদের বেতন কম এ কথাটা Naturally-ই সবাই জানে ৷ এটি কেউ জানতে বা শিখতে হয় না৷ অাসলে বেতন কম না; অন্যান্য চাকরিজীবীদের মতো শিক্ষকদেরকে যে বাড়ি ভাড়া,মেডিক্যাল ভাতা, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য ভাতা দেয়া হয় না; তাই এ পেশার লোকদের বেতন কম বলেই সবাই জেনে থাকেন ৷

অামি শহর থাক দূরের কথা উপজেলা সদরেই বাসার কথা কোনদিন ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি না ৷তাই একটি জুট মিলের পাশেই গ্রামের একটি বাড়িতে বাসা নিয়ে থাকি ৷ একদিন সন্ধ্যায় মিলের তথা কথিত দুই জন অফিসারদের সাথে অালাপ চলছিল৷ তখন তারা তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খোজ খবর নিচ্ছিল ৷ তাদের সাথে ছিল ঐ মিলেরই একজন গাড়ি চালক ৷

এক পর্যায়ে চাকরির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, অসুবিধা ও চাকরির অবস্থানের অালাপ এসে পড়লো ৷ কথার এক পর্যায়ে গাড়ি চালক বলে উঠলো , “মাস্টারগো তো বেতন কম ৷ এ টাকা দিয়ে তারা চলে কিভাবে?” অামি ভাবলাম গাড়ি চালকের মুখেই শিক্ষকদের বেতন সম্পর্কে এ মন্তব্য তাহলে তার অফিসারদের মুখে যেন কি মন্তব্য থাকতে পারে! তাই, অামি তো অালাপ বন্ধ করে নিজেকে খুব ব্যস্তভাব দেখিয়ে স্থানটি দ্রুত ত্যাগ করলাম ৷

যদি শিক্ষকদের সকল সুযোগ সুবিধা শিক্ষকদেরকে দেয়া হতো বা স্কুলগুলো যদি জাতীকরণ করা হতো,তাহলে কি এ সকল অপমানজনক মন্তব্য কারো মুখ দিয়ে অাসতো? অামার সহকর্মি শিক্ষক একদিন তাদের গ্রামের একটি মাহফিলে দাওয়াত করলে অামি উৎসাহ নিয়েই তার সাথে গেলাম ৷

রাতভর মাহফিল শোনলাম ৷ পরের দিন সকালে তিনি অামাকে তাদের গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন ৷ হঠাৎ তার বাড়ির শহর থেকে অাসা এক চাচি অনেকদিন পর দেখে তাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন অাছো? এখন কী করছো?” তিনি উত্তর দিলেন, ”অামি একটি হাই স্কুলে অাছি ৷” শুনে তার চাচি তাকে বললেন, ‘মাস্টারি করছো! কোন চাকরি বাকরি ব্যবস্থা করতে পারলা না?’ দেখুন মাস্টারির প্রতি সমাজের কি ধারনা ৷ যদি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকতাকে সরকার সম্মানজনকভাবে মূল্যায়ণ করতো তাহলে হয়ত ওনার চাচি ওনাকে অভিনন্দন জানাতো!

ঐ স্যারের চাচাতো ভাই এইচএসসি পাশ করার পরে সৌদি চলে যায় ৷ ১০ বছর পরে সৌদি থেকে এসে হঠাৎ অামার সাথে বাজারে দেখা হলো ৷ সে অনেক টাকা অর্জন করেছে ৷

বাড়িতে অনেক সুন্দর করে বাড়ি বানিয়েছে জায়গা জমি কিনেছে এবং অামার সাথে এ গল্প করতে করতে ঐ শিক্ষকের নাম ধরে বলল, ‘ভাইয়ে ১২ বছর ধরে মাস্টারি করতেছে, কিছুই করতে পারে নাই, হেরে কতবার কইলাম একটা ভিসা পাঠাই, কোন কথা হোনল না, এখন পোলাপাইন নিয়া টানাটানির মধ্যে চলে ৷’

অারেকটি গল্প মনে পড়ে গেল ৷ এক শিক্ষক বিয়ের পড়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সকালে স্কুলে অাসার জন্য খুব তাড়াহুড়া করতেছিল ৷ তার স্ত্রীকে তার শ্বাশুরি জামাইর তাড়াহুড়া করার কারন জিজ্ঞাসা করল৷ স্ত্রী বলল যে, তার স্বামির স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার চলছে ৷ শ্বাশুরি তো এ কথা শুনে হতবাক ৷ তিনি অার কথা বলছিলেন না ৷

ওই শিক্ষক শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করাতে না করতেই দৌড়ে তার শ্বাশুরি শ্বশুকে বলল, ‘তুমি না বলেছিলা জামাইয়ে চাকরি করে, এখনদি শোনলাম মাস্টারি করে!’ এর মানে কী?

শিক্ষকতা করে এ কথাটা শোনলে মানুষ অবাক ও মুখ থেতলে মন্তব্য করে কেন? কোন সরকারি স্কুলে শিক্ষক হলে তো এরকম করে না? অামাদের অপরাধ কী? অামরা কি কম পরিশ্রম করি? অামাদের স্কুলের ফলাফল কি ভাল হয় না নাকি অামরা কারো করুনায় পেশাটা গ্রহণ করেছি?

অামাদের বাড়ি ভাড়া নামে মাত্র দেয়া হয় কেন? সবাই বৈশাখি ভাতা পেল অামরা পেলাম না কেন? ঈদ বোনাস সকল সরকারি চাকুরেরা শতভাগ পায় অামরা কেন ২৫% দেয়া হয়? বাজারে কি অামাদের জন্য অালাদা জামা কাপড় বিক্রি হয় যেগুলো শিক্ষক হলে ৭৫% ছাড়?

অামাদের জন্য কি সরকার অালাদা বাড়ির ব্যবস্থা রেখেছে যেখানে ১০০০ টাকায়ই থাকা যায়? বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল কি শিক্ষকেরা দেয়া লাগে না? সরকারি চাকুরেরা শিক্ষা ভাতা পাবে অার অামাদের ছেলে মেয়েরা কি মুর্খ থাকবে? তাহলে কেন বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতা ও ইনক্রিমন্ট অামাদেরকে দেয়া হবে না? উক্ত প্রশ্নগুলো সর্বদাই সকল শিক্ষকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়ে মনের ভিতরই ঘুরপাক খায় ৷ কখন যেন সেগুলো ঘুর্ণিঝড়ে পরিনত হয় তা বলা যাচ্ছে না ৷

পরিশেষে বলতে চাই, মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, অাপনিই ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এক যোগে জাতীয়করণ করে মহানুভবতা ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন ৷ অাপনি জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা ৷ শিক্ষকদের প্রতি সহানুভুতিশীলতা অাপনারই খাটে ৷ তাই অার কালক্ষেপন না করে সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে একযোগে জাতীয়করণ করে বাংলাদেশে অারেকটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষক সমাজ অাপনার দিকে অধির অাগ্রহে তাকিয়ে অাছে ৷

মোঃ মহসিন মিয়া। সহকারি শিক্ষক, ইংরেজি ,বড় গোবিন্দপুর এএমবি উচ্চ বিদ্যালয়
চান্দিনা,কুমিল্লা ৷

নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ৮:২২ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৬, বৃহস্পতিবার
এইউ

Leave a Reply