Home / জাতীয় / তেরো শ’ নদী কোথায় গেছে আমরা কি তার সন্ধান করেছি?
hot seson river
চিত্র : মেঘনা নদী

তেরো শ’ নদী কোথায় গেছে আমরা কি তার সন্ধান করেছি?

বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। সৈয়দ শামসুল হক ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ এই তেরো শ নদী কোথায় গেছে আমরা কি তার সন্ধান করেছি?

এখনো অবশিষ্ট নদীগুলো আমরা সংঘবদ্ধভাবে খেয়ে ফেলছি। আমাদের দেশ হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ। অথচ পাঠ্যপুস্তকে এমন কোনো পাঠ নেই, যা শিক্ষার্থীদের নদীর প্রতি দায়িত্বশীল করে তুলবে।

বিশ্ব নদী দিবস প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি।

এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে।

তেরো শ’ নদী কোথায় গেছে আমরা কি তার সন্ধান করেছি?

ডাকাতিয়া নদী

গত দুই বছরে রিভার ইন পিপল এবং একটি জাতীয় দৈনিকের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নদী অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই প্রতিযোগিতায় উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে বিভিন্ন স্থানে যে প্রশ্নটি বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী করেছিল সেটি হচ্ছে, ‘নদীর জন্য আমি কী করতে পারি?’ এই প্রশ্ন প্রমাণ করে, আমাদের তরুণেরা নদীর জন্য কাজ করতে চায়। আমরা সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থাই নদীর প্রতি জাতিকে দায়িত্বশীল করে তুলতে পারিনি। তাই সামান্য বৃষ্টিতে আমাদের জলাবদ্ধতা আর মাঝারি বৃষ্টিতে নেমে আসে বড় বন্যা।

চলতি বছর দেশের উত্তরাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা হলো, এর প্রধান কারণই হচ্ছে নদীর প্রতি যত্ন না নেওয়া। অতিবর্ষণ হলে বন্যা হবে, এটা প্রাকৃতিক। এই সত্যকে মেনে নিয়ে বলা যায়, সরকার যদি নদীর প্রতি যত্নবান হতো, তাহলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, এতে এত বন্যা হতো না।

লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ধরলার পানিতে। সরকারপরম্পরায় কোনো সরকারই নদী খননের উদ্যোগ নেয়নি। আগে ধরলার যত পানি শাখা নদী বহন করত, এখন সেটাও বন্ধ। তাই বাঁধ ভেঙে মানুষের জান–মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

Meghna river

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে উঁচু এলাকা হচ্ছে দিনাজপুর। এই দিনাজপুরও এবার পানিতে ডুবেছিল। এরও অন্যতম কারণ নদীর প্রতি যত্ন না নেওয়া। আত্রাই নদের পানি বের হয়ে গেছে গর্ভেশ্বরী নদীতে। আত্রাই ও গর্ভেশ্বরী এ দুটির কোনোটিরই যত্ন সরকার নেয় না। গত শীতে আত্রাই নদের চরের ওপর দিয়ে বালু বহন করা গাড়ি পার হতে দেখেছি। দিনাজপুরের পশ্চিমের নদী পুনর্ভবা। গত শীতে দেখেছি, এই নদী একেবারেই শুকিয়ে গেছে। গরু-ছাগল বাঁধা সেখানে। সেই নদীর পানিও ঢুকেছিল দিনাজপুরে। রংপুর জেলার অনেক স্থানে বন্যা হয়েছে ঘাঘটের প্রতি যত্ন না নেওয়ার কারণে। আখিরা নদের যত্ন না নেওয়ার কারণেও বন্যা হয়েছে রংপুরের পীরগঞ্জ এলাকায়।

এই বন্যা ছাড়াও প্রতিবছর তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-দুধকুমরসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা হয়। একবারের বন্যায়
যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সেই পরিমাণ টাকা যদি ওই সব ক্ষতির কারণ নির্ণয় করে নদীর যত্নে ব্যয় করা যেত, তাহলে বন্যা অনেকটাই কমত।

আমাদের দেশে নদী দখলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকার যুক্ত না থাকলে কখনো নদী দখল হয় না। সরকারের দুর্বলতার কারণে নদী দখল হয়। আর এই নদী দখল হতে হতে এবং অযত্ন করতে করতে আমাদের জলপথ কমে আসছে। কয়েক দিন আগে ‘রংপুর বিভাগ: আন্তদেশীয় নদী ও জীবন’ শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আমাদের ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। এখন তা মাত্র ৫-৬ হাজারে নেমে এসেছে। ১৮ হাজার জলপথ নেই। আর জলপথ কমতে দেওয়া হবে না।’ দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যের বাইরে আর কিছুই মিলছে না।

বর্তমান সরকার নদীর জন্য কিছুই করেনি—এ কথা বলা যাবে না। বেশ কিছু আইন ও উদ্যোগ আছে এই সরকারের। তবে এসবের প্রয়োগ-বাস্তবায়ন কিছুই নেই। ২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা আইন হয়েছে এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আইনের ১২ ধারায় ১৩টি বিষয়ে সরকারকে শুধু সুপারিশ করার কথা বলা আছে। শুধু সুপারিশ করা যদি কমিশনের কাজ হয়, তাহলে কমিশন নিজের থেকে কী
কাজ করবে?

সরকারের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হচ্ছে সারা দেশের সব জেলা এবং উপজেলায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে নদী রক্ষা কমিটি গঠন করা। যদিও এগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই এখন পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কেউ যদি নদী দখল করে, তার বিরুদ্ধে শাস্তিরও বিধান করেছে সরকার। কিন্তু এর কোনো প্রয়োগ নেই। নদী রক্ষায় সরকার যেটুকু সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, সেটুকুর যদি প্রয়োগ থাকত তাহলে আর নতুন করে কোনো নদী কেউ দখল করতে পারত না।

আমাদের নদী রক্ষায় দুই রকম ব্যবস্থাপনা জরুরি। একটি হচ্ছে দেশীয়, অন্যটি আন্তর্জাতিক। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করে আমরা আমাদের নদীগুলোর সুরক্ষা করতে পারব। কিন্তু অন্য দেশ থেকে আসা নদীগুলো রক্ষা করতে হলে উভয় দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। আমাদের ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৩টিরই উৎস ভারত। ভারত এখন উজানের নদী থেকে পানি একতরফা প্রত্যাহার শুরু করেছে। অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতিসংঘ ২০১৪ সাল থেকে আইন প্রণয়ন করেছে। ১৯৯৭ সালে পানিপ্রবাহ কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও এখন পর্যন্ত অনুসমর্থন করেনি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি অনুসমর্থনের জন্য। কিন্তু সরকার কী কারণে করে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

ভারত তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের জন্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত আন্তনদী সংযোগের নামে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে ভারত থেকে কোনো পানি আসবে না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।

আমরা সরকারের কাছে একটি জাতীয় নদীরও দাবি করে আসছি অনেক দিন থেকেই। আমাদের ফুল-ফল-মাছ-উদ্যানসহ অনেক বিষয়ের জাতীয় স্বীকৃতি আছে। অথচ নদীমাতৃক দেশে নদীর জাতীয় স্বীকৃতি নেই। আমরা চাই সরকার একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করুক।

আজ বিশ্ব নদী দিবস। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস এবং নদী অধিকার দিবস বলে আরও দুটি দিবস আছে। এর কোনোটিই আমাদের সরকার পালন করে না। নদীর প্রতি যত্ন না নেওয়ার কারণে এত ক্ষতি হচ্ছে, তবু কি সরকার নদীর প্রতি দায়সারা গোছের দায়িত্বশীলই থাকবে?

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল।

: : আপডেট, বাংলাদেশ ২: ০০ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রোববার
ডিএইচ

Leave a Reply