Home / জাতীয় / অর্থনীতি / বায়োমেট্রিক ছাড়াই মোবাইল ফোনের ভুয়া সিম
বায়োমেট্রিক ছাড়াই মোবাইল ফোনের ভুয়া সিম

বায়োমেট্রিক ছাড়াই মোবাইল ফোনের ভুয়া সিম

হাত বাড়ালেই ভুয়া সিম!বায়োমেট্রিক ছাড়াই ভুয়া রেজিস্ট্রেশনকৃত বিক্রি হচ্ছে এসব অবৈধ সিম।তাই চাইলেই এখনও পাওয়া যায় মোবাইল ফোনের ভুয়া সিম। কিনতে পাওয়া যায় মুদি দোকানে। আর এসব সিম ব্যবহার করে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলছে।

অথচ এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে সরকার সিম পুনঃনিবন্ধনের মতো এক বিরাট মহাযজ্ঞ বাস্তবায়ন শেষ করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে- সবই যেন বজ আঁটুনি ফসকা গেরো। একটি চক্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একাধিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নাম, ঠিকানা ও ছবি জালিয়াতি করে চড়া মূল্যে বাজারে প্রিঅ্যাক্টিভেটেড সিম বিক্রি করছে। প্রতিনিধির মাসব্যাপী অনুসন্ধানে এ বিষয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও এ ধরনের জাল-জালিয়াতির বিষয়টি জানেন বলে প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন। রোববার তিনি প্রতিনিধিকে বলেন, কমবেশি সব অপারেটরের সিমই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। এ বিষয়ে শিগগিরই তারা শক্ত ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন।

৬৫০ টাকায় মেলে সিম : ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, হাত বাড়ালেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া নিবন্ধনকৃত মোবাইল সিম মিলছে। বেআইনি হওয়ায় এসব সিমের দামও চড়া। ৬৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে এসব অবৈধ সিম।

অনুসন্ধানের স্বার্থে একটি বায়োমেট্রিক নিবন্ধনকৃত সক্রিয় (প্রি-অ্যাক্টিভেটেড) সিম কিনতে চায় প্রতিনিধি অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এ ধরনের সিম সহজলভ্য সাভারের হেমায়েতপুরসহ রাজধানীর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, যাত্রাবাড়ী ও মহাখালী এলাকার বেশ কিছু মোবাইল ফোন এক্সসরিজের দোকানে।

সোর্সের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হেমায়েতপুরের যথাযথ ঠিকানায় পৌঁছে যায় অনুসন্ধানী টিম। বাজারের কয়েকটি মুদি দোকানে খোঁজ করতেই এক দোকানে দেশের অন্যতম মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি’র শত শত সিম বিক্রি করতে দেখা গেল। ওই দোকানে রবি’র উদয় এসএমই প্যাকেজের সম্পূর্ণ নতুন নিবন্ধিত সিম পাওয়া গেল অতি সহজেই।

১০ টাকার রিচার্জসহ দাম পড়ল ৬৫০ টাকা। অথচ বাজারে মোবাইল কোম্পানিভেদে প্রিপেইড সিমের বর্তমান মূল্য সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা। এত দাম কেন জানতে চাইলে হেমায়েতপুরের ওই দোকানি বলেন, ‘এগুলো সিস্টেমের সিম। তাই দাম একটু বেশি।’

এরপর ওই দোকানির কাছ থেকে ৬৫০ টাকা দিয়ে একটি সিম কেনা হল। সংযোগটির নম্বর ০১৮৪-৩১৪৬৯৮৮। বিশেষভাবে প্লাস্টিকের মোড়কে মোড়ানো সিমটি খুলে ফোনসেটে ঢুকানোর পর দেখা গেল সিমটি পুরোপুরি সক্রিয়। পরীক্ষা করতে একটি ফোন কলও করা হয়। সিমটি দিয়ে কথা বলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেল যে, বাজারে প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম পাওয়া যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হল- এই সিমের নিবন্ধন কার নামে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা এর ছবিই বা কার। যার নামে নিবন্ধন করা কী তারই বা কি পরিচয়। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার সহায়তা নেয় প্রতিনিধি অনুসন্ধান সেল।

এরপর সংশ্লিষ্ট সিমটি যার নামে নিবন্ধন করা তার বিস্তারিত পরিচয় বহনকারী ফরমেটটি (নিবন্ধনের সময় ছবিসহ যে ফরম পূরণ করা হয়) প্রতিনিধির হাতে চলে আসে। কিন্তু ফরমের ঠিকানা অনুযায়ী অনুসন্ধানে নেমে হতবাক হতে হয়। ঠিকানা অনুযায়ী প্রতিবেদক রোববার পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম সদরের আসাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টি।

ফরমে উল্লেখ করা হোল্ডিং নম্বর সঠিক পাওয়া গেল। কিন্তু মিলল না গ্রাহকের নাম কিংবা ছবি। সিম রেজিস্ট্রেশন ফরমে লেখা আছে নিবন্ধিত ব্যক্তির নাম মো. আবুল। পিতা : আবু সাঈদ। মাতা : হাজরা বেগম। ঠিকানা : ২১৭ আছাদগঞ্জ, শুঁটকিপট্টি, চট্টগ্রাম। নিবন্ধন ফরমে একটি অস্পষ্ট ছবি সাঁটানো আছে।

কিন্তু এ হোল্ডিংয়ের ঠিকানায় আবুল নামের কেউ নেই। এই হোল্ডিংয়ের মালিক বদিউর রহমান সওদাগর যুগান্তরকে বলেন, এখানে আবুল নামে কেউ থাকে না। তার তিন ছেলের কারও নামও আবুল নয়। নিবন্ধন ফরমে দেয়া ছবি দেখে বদিউর রহমানের ছেলে নাজিমুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এই ছবির লোককে চেনা তো দূরের কথা তাকে কখনও দেখেননি।

তিনি জানান, তাদের ঠিকানা ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয়ে কেউ সিম নিবন্ধন করে থাকতে পারে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট সিমটি ২০১১ সালের ৯ মে প্রথম বিক্রি হয় চট্টগ্রামের কবির টেলিকম নামের একটি দোকান থেকে।

দোকানের মালিকের নাম রাজ্জাক। ঠিকানা মরিয়মনগর চট্টগ্রাম। তবে ফোনটি কখন পুনরায় বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই। নিবন্ধন ফরমে রেফারেন্স নম্বর হিসেবে আদিল নামের একজনের মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। নম্বরটি হল ০১৮২-৯৭৭৮৩৭৬।

এরপর এই নম্বরে কল করা হয়। অপরপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করা হয়। কিন্তু তিনি জানান, এটি আদিল নামে কারও মোবাইল নম্বর নয়। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি বলেন, তার নাম আলমগীর হোসেন। বাড়ি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায়। এমনকি আবুল নামে কাউকে তিনি চেনেন না বলেও জানান। এ ছাড়া রেফারেন্স হিসেবে কাউকে তিনি তার নম্বর ব্যবহার করতেও দেননি।

অনুসন্ধানের শেষ প্রান্তে এসে বোঝা গেল সিম নিবন্ধন ফরমে রেফারেন্স হিসেবে যার মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার করা হয়েছে তা সঠিক নয় এবং এটিও জালিয়াতি করা।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রবি অপারেটর নয়, জালিয়াত চক্র প্রতিটি ফোন কোম্পানির সিম এভাবে জাল-জালিয়াতি করে বাজারে ছাড়ছে। কেননা, গত জুন মাসে র‌্যাব পরিচয়ে ০১৭৩৫৪১৬১০৬ নম্বর থেকে ফোন করে পুরান ঢাকার জনৈক ব্যবসায়ীর কাছে সন্ত্রাসীরা ২০ লাখ টাকা দিতে দু’দিনের সময় বেঁধে দেয়।

এ সময়ের মধ্যে টাকা না পেলে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকিও দেয়া হয়। বিষয়টি জানার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করা হয়। এরপর জানা যায়, হুমকি দেয়া নম্বরটি ছিল ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা। এর ফলে জাল-জালিয়াতি রোধে সরকার আঙুলের ছাপ নিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম পুনঃনিবন্ধনের মতো এক মহাযজ্ঞ সম্পাদন করলেও তা এক অর্থে কাজে আসছে না। বলা যায়, এটি বজ আঁটুনি ফসকা গেরোতে পরিণত হয়েছে। কেননা চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের প্রি-অ্যাক্টিভেট করা ভুয়া সিম পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

স্বভাবত এখন প্রশ্ন হল, এত কিছুর পরেও এভাবে বাজারে প্রি-অ্যাক্টিভেট সিম কীভাবে আসছে? গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফোন কোম্পানিগুলোর কারও না কারও সম্পৃক্ততা ছাড়া এভাবে প্রি-অ্যাক্টিভেট সিম পাওয়া সম্ভব নয়। তারা জানতে পেরেছেন, সিম পুনঃনিবন্ধনের সময় সাধারণ মানুষের অনেকের কাছ থেকে একাধিকবার আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। মূলত ওইসব আঙুলের ছাপের সঙ্গে ভুয়া নাম-ঠিকানা ও ছবি যুক্ত করে বাজারে চড়ামূল্যে সিম বিক্রি করছে চক্রটি।

এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে জানান, দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নতুন সংযোগ কিনতে হলে অবশ্যই ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড জমা দিতে হবে।

এরপর সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাছে আঙুলের ছাপ দেয়ার পর তা ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে মিললে সিম কেনা যাবে। এরপর বিটিআরসি সংযোগটি সক্রিয় করবে। এ নিয়মের বাইরে কোনোভাবেই সিম চালু হওয়ার সুযোগ নেই।

মন্ত্রীর বক্তব্য : মোবাইল সিমের ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি স্বীকার করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম রোববার তার কার্যালয়ে প্রতিনিধিকে বলেন, প্রায় সব মোবাইল ফোন অপারেটরের এ ধরনের সিমকার্ড বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা ৪ হাজার ২২১টি সিম কার্ড শনাক্ত করেছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবিলম্বে এসব সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হবে। একইসঙ্গে প্রতিটি অবৈধ সংযোগের জন্য ৫০ ডলার করে জরিমানা আদায় করা হবে।

প্রতিমন্ত্রী জানান, কিছু অসাধু রিটেইলার কারসাজির মাধ্যমে এ ধরনের কাজ করছে। তিনি বলেন, সিম নিবন্ধনের জন্য আঙুলের ছাপ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই দুটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত নিবন্ধনের সময় দেখে নিতে হবে, কম্পিউটারে যে নম্বরের নিবন্ধন করা হচ্ছে সেটি তার কিনা।

তাছাড়া একটি সংযোগের বিপরীতে আঙুলের ছাপ দেয়া সাকসেস হওয়ার পর আবার আঙুলের ছাপ না দেয়া। মন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, অবৈধ সিম রেজিস্ট্রেশনের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুন রাজধানীর তেজগাঁও থেকে অবৈধভাবে নিবন্ধন করা এক লাখ সিমকার্ড জব্দ করে পুলিশ। এ সময় ২২ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ৩ জন ছিলেন মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারটেলের টেরিটরি ম্যানেজার।

এছাড়া গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৩২১টি সিম উদ্ধার করা হয়। রবি, এয়ারটেল ও গ্রামীণফোনসহ বিভিন্ন অপারেটরের এসব সিম উদ্ধারের ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করে মামলা করে চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশ।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ রোববার প্রতিনিধিকে জানান, এ ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের সবাই আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।যুগান্তর

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৯:৫০ এ,এম ১৬ আগস্ট ২০১৬,মঙ্গলবার
ইব্রাহীম জুয়েল

Leave a Reply