Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / ফরিদগঞ্জে ১০ টাকার চাল বিক্রিতে একি হচ্ছে?
ফরিদগঞ্জে ১০ টাকার চাল বিক্রিতে এ কি হচ্ছে?

ফরিদগঞ্জে ১০ টাকার চাল বিক্রিতে একি হচ্ছে?

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের কারণে সরকারের চমৎকার এ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিপন্ন হওয়ার পথে।

ইউপি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বাছাইকৃত হতদরিদ্র জনগণকে চাল দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু একাধিক অভিযোগ আসছে মেম্বাররা উৎকোচের বিনিময়ে অস্বচ্ছলদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের চালের কার্ড দিচ্ছে।

যার কারণে সঠিক ব্যক্তিরা এই ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া চালের সুবিধা পাচ্ছে না। এছাড়া যারা পেয়েছে তারাও ডিলারের দ্বারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেকেই অভিযোগ তুলছেন ডিলাররা চাল মাপে কম দিচ্ছেন। আবার অনেক ডিলার চালের কার্ডে ৩টি স্বাক্ষর রাখলেও ২বার চাল বিতরণ করেছে।

সরকারের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণের বিভিন্ন ইউনিয়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে কার্ড পাওয়া ও না পাওয়া হত দরিদ্রদের মৌখিক অভিযোগ অনুসারে ডিলার, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও টেগ অফিসারের সাথে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

১ নং বালিথুবা (উঃ) ইউনিয়নের ডিলার পয়েন্টে গেলে ডিলার মোজাম্মেল হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ, ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার মহিবুল্লাহর উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের ভুক্তভোগীরা তাদের কার্ড দেখিয়ে বলেন যে, অন্যান্য ইউনিয়নে তৃতীয় কিস্তির চাল বিক্রি হলেও আমরা পেয়েছি মাত্র ২ বার।

এাছাড়া ওয়ার্ড মেম্বারগণ ৩’শ থেকে ৫’শ করে টাকা নিয়ে তাদের কার্ড দিয়েছে। ১নং ইউনিয়নের অধিকাংশ অনেক কার্ডের নাম ফ্লুয়েট (সাদা কালি) দিয়ে মুছে ফেলে অন্য নামে চাল উত্তোলন করা হচ্ছে। কার্ডের নাম্বারের সাথে তালিকায় থাকা নামের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বালিথুবা ইউনিনের কার্ডধারী বাবুল, রাবেয়া, ফাতেমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, রুহুল আমিন মেম্বার, বিল্লাল মেম্বার ও মহিলা মেম্বার পারভীন আক্তার পাখি, কার্ড দেওয়ার সময় আমাদের অনেকেরই কাছ থেকে কার্ডের বিনিময়ে টাকা নিয়েছে।

ওই এলাকার বাহাউদ্দিন, রেহেনা, ছিদ্দক, শামছুর রহমান, আঃ রশিদসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, ডিলারের কাছ থেকে ৩’শ টাকা দিয়ে গত মাসে ৩০ কেজি চাল নিয়েছি কিন্তু বাড়িতে মাপ দিয়ে দেখি ২৭-২৮ কেজি।

এ ক্ষেত্রে প্রচন্ড গড়মিল দেখা গেলে ডিলার বলেন, ‘এগুলো চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশে মেম্বাররা করেছে। ডিলার আরো বলেন, আমরা আগে জানলে ডিলারশিপ নিতাম না। চাল ক্রয় ও বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে বিক্রির কমিশন হিসাব করলে আমাদের প্রতিবারেই লস আসে। প্রতি টনে লোড খরচ ১৫০ টাকা, আনলোডের সময় প্রতি বস্তায় ১৩/১৪টাকা, এ খরচগুলো হিসাবের বাইরে থাকে। প্রতি বস্তায় চাল কম থাকে অন্তত ৬শ’ গ্রাম। আপনি বলেন এগুলো আমরা কিভাবে পোষাবো।’

১নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘কার্ডে ও তালিকায় যাদের নাম এসেছে, পরবর্তীতে দেখা গেছে এদের অনেকেই স্বচ্ছল এবং তাদের তুলনায় অনেক হত-দরিদ্র রয়ে গেছে এজন্য আমরা প্রথম কিস্তির পর কার্ডের নাম পরিবর্তন ও সমন্বয় করে অন্যদের মাঝে বিক্রি করার জন্য বলেছি। কয়েক জন মেম্বার ও মহিলা মেম্বারদের কার্ডের বিনিময়ে টাকা নেওয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে কিছু অনিয়মের কথা স্বীকার করে চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান বলেন, এটা সত্যি যে, কিছু কিছু বিষয়ে অনিয়ম হচ্ছে।

১নং ইউনিয়নের টেগ অফিসার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মাকসুদ আলম উপরোক্ত অভিযোগের বিষয়ে বলেন, আমি ব্যস্ততার কারনে ঠিকমত যেতে পারি না এবং খবরও নিতে পারি না। অনিয়মের বিষয়ে আমার কাছে কোন অভিযোগ নেই। সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এসব কার্ড পাওয়ার যোগ্য নয় এমন লোকদেরও কার্ড দেওয়া হয়েছে। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে বেশকিছু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মহিলা মেম্বাররা হত-দরিদ্রদের পাশাপাশি তাদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কার্ড বিতরণ করেছেন। এমন কি অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের অনেকেও কার্ড পেয়েছেন। বর্তমান সরকারের মহৎ উদ্যোগ সফল বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মহিলা মেম্বার হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমি কিছু কিছু অনিয়ম দেখতে পেয়ে সাথে সাথে চেয়ারম্যান সাহেবকে অবহীত করেছি।’

২নং বালিথুবা (দঃ) ইউনিয়নের কার্ড বিতরনে এমন একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট।

শুক্রবার ডিলার পয়েন্ট একতা বাজারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কেউ নেই।

পরে দুপুর একটায় ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে গেলে দেখা যায় প্রায় শতাধিক কার্ডধারী হত-দরিদ্র, যাদের মধ্যে দিন-মজুর, রিক্সা চালক এমনকি একবারে ছোট শিশু সন্তান নিয়ে মা’রা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাল ক্রয়ের আসায় অপেক্ষা করছে। নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে চাল বিক্রির কথা থাকলেও ডিলার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আসার নাম গন্ধও নেই। ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার হাসিনা বেগম, ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার ফরিদা বেগম ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুস সাত্তার ও দফাদার বাহাউদ্দিনের উপস্থিতিতে কার্ডধারী বিক্ষুব্দ হত-দরিদ্ররা জানান, আমাদের সারাদিনের রোজগার বন্ধ রেখে বা সংসারের কাজকর্ম ফেলে শিশু সন্তান নিয়ে অধিকাংশ সময়ই এভাবে অপেক্ষা করি। ৩য় বারের মত চাল দিলেও ২নং বালিথুবা ইউনিয়নে পেয়েছে মাত্র ১মাসের। অধিকাংশ কার্ডধারীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ২শ টাকা থেকে শুরু করে ৬শত টাকা পর্যন্ত।

২নং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদকে উপরোক্ত অভিযোগের বিষয় জানালে তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের জন্য একবারই চাল পেয়েছি। হত দরিদ্রদের তালিকা প্রনোয়নে সমস্যার কারণে কার্ড বিতরণে দেরী হওয়াতে প্রথম মাসের চাল উত্তোলন না করতে পারায় হত দরিদ্ররা সেপ্টেম্বর মাসের চাল ক্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘টেগ অফিসার ও আমি উপস্থিত না থাকার কারণে গত শুক্রবারে চাল বিক্রি করা হয় নাই।’

২নং ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বে থাকা টেগ অফিসার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মানসুর হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘আমরা কোনো কারনে না যেতে পারলেও নির্দিষ্ট তারিখ এবং সময়ে চাল বিক্রি করতে হবে। জনগন যেনো আমাদের কারনে ভূক্তভোগি না হয়। তাছড়া, ২নং ইউনিয়নে একই ঘরে একাধীক কার্ড বিতরন, ডিলারের আত্মিয়ের নামেও কার্ড দেওয়া হয়েছে। যা তদন্ত করে উপজেরা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট পেশ করেছি। এখন স্যার সিদ্ধান্ত দিবেন। ২নং বালিথুবার ডিলার পয়েন্টের ঠিকানা দেয়া হয়েছে একতা বাজারে কিছু ডিলার বাজার ছাড়াও ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে বিক্রি করছে। যা নিয়মবহির্ভুত এ ব্যপারে আমি নির্বাহী অফিসার স্যারকে আমি জানিয়েছি।’

খাদ্য কর্মকর্তা শামসুল হুদা বলেন, ১,২, ৩ ও ৯নং ইউনিয়নের হত-দরিদ্রদের তালিকা প্রনয়ণে জটিলতা ও ডিও’র টাকা ঠিকমত জমা দিতে না পারায় ১ম কিস্তি অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের চাল উত্তোলন করতে পারে নাই ঐ সকল ইউনিয়নের ডিলারগন। তাদের কারনে ৪টি ইউনিয়নের হত-দরিদ্ররা কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

সার্বিক অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবদীন সাহেবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমার কাছে দু একটি অভিযোগ এসেছে। আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থাও নিচ্ছি। কিছু ঘটনা সত্য আবার কিছু মিথ্যা। আমি চাই সচ্ছতার সাথে সরকারের মহৎ বাস্তবায়ন করতে। প্রমাণ সাপেক্ষ কোনো ধরণের অভিযোগ থাকলে আমি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিবো। যারা গরীবের হক ১০ টাকা কেজির চালের প্রতি লোভ করে তারা অমানুষ।’

আতাউর রহমান সোহাগ : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৮:৫০ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৬, রোববার
ডিএইচ

Leave a Reply