Home / সারাদেশ / নারায়নগঞ্জের ৭ খুন : ২৬ আসামীর মৃত্যুদণ্ড
নারায়নগঞ্জের ৭ খুন : ২৬ আসামীর মৃত্যুদণ্ড

নারায়নগঞ্জের ৭ খুন : ২৬ আসামীর মৃত্যুদণ্ড

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় পাঁচ বাহিনীর সাবেক ১৬ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তাঁর অপরাধজগতের ৯ সহযোগী।

এ ছাড়া ওই সব বাহিনীর আরও নয় সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ক্ষমতার দাপটে প্রভাবশালীদের অপরাধ বিভিন্ন সময়ে মাফ হয়ে যাওয়ার প্রচলিত ধারনা গতকাল আদালতের রায়ে ভুল প্রমাণিত হলো।

সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী থেকে প্রেষণে র‌্যাবে আসেন। অপরাধ সংঘটনের সময় তাঁরা সবাই র‌্যাব-১১-তে কর্মরত ছিলেন। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন সেনাবাহিনী থেকে, ২ জন নৌবাহিনী থেকে, ৩ জন বিজিবি, সাতজন পুলিশ ও ২ জন আনসার থেকে র‍্যাবে যোগ দেন। সাত খুনের মামলার পর তাঁদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত জনাকীর্ণ এজলাসে এই রায় ঘোষণা করেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি বলেন, অপহরণ, হত্যা, লাশ গুম ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপহরণ ও আলামত অপসারণে যুক্ত থাকায় বাকিদের ১০ বছর ও সাত বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় গ্রেপ্তার থাকা ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, একসঙ্গে এত মানুষকে অপহরণ, হত্যা ও গুমের মতো ভয়ংকর অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত বিপুলসংখ্যক সদস্যের একযোগে জড়িত হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।

সোমবার রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার জানামতে, এটি এ দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মামলা, যেখানে ২৬ জনের ফাঁসি হলো।’ তিনি বলেন, এই রায়ে সমগ্র জাতি স্বস্তি পেয়েছে। এর মাধ্যমে ভিকটিম ও জনগণ প্রত্যাশিত রায় পেয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো, কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। মামলাটি হাইকোর্টে এলে দ্রুত শুনানি শুরু করার চেষ্টা করা হবে।

কে কী শাস্তি পেলেন
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সৈনিক আবদুল আলিম (পলাতক), সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি (পলাতক), সৈনিক আল আমিন (পলাতক), সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক), সার্জেন্ট এনামুল কবির (পলাতক), নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম (পলাতক), সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক) ও জামাল সর্দার (পলাতক)।

১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন (পলাতক) ও করপোরাল মোখলেছুর রহমানকে। আর কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (পলাতক), হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে সাত বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন আদালত। মোখলেছুরকে অপহরণে যুক্ত থাকার দায়ে ১০ বছর ছাড়াও আলামত অপসারণে যুক্ত থাকার দায়ে আরও সাত বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

আদালতে যা হলো
আলোচিত সাত খুন মামলার রায় উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ আদালত এলাকা ও আশপাশে ছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিচারক আসার বেশ আগেই এজলাসকক্ষ ভরে যায় সাংবাদিক ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। এজলাসকক্ষের ভেতর আসামিদের রাখার জন্য কাঠগড়ার স্থলে একটি লোহার খাঁচা ছিল। সকাল নয়টার আগেই বেশ কিছু আসামিকে সেই খাঁচার ভেতরে এনে রাখা হয়। পৌনে ১০টার দিকে তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ, লে. কমান্ডার রানা ও নূর হোসেনকে আনা হয় এজলাসে।

১০টার দিকে এজলাসে নিজ আসনে এসে বসেন বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি মামলা। দুটি এজাহার। দুটি মামলায় রায় ভিন্ন। ১৭৪৮/১৫ (মামলা নম্বর)-এর দুজন ভিকটিম, ১০৩/১৬ (মামলা নম্বর)-এ পাঁচজন ভিকটিম। দুটি রায় ভিন্ন হলেও ফলাফল এক বিবেচিত হবে। আপনারা কথা বলবেন না। রায়ের অংশবিশেষ পড়ছি।’ এরপর তিনি প্রথমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নয়জনের সাজার বর্ণনা পড়ে শোনান।

এরপর তিনি একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ আসামির নাম উল্লেখ করে তাঁদের সাজার ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে এজলাসে থাকা আইনজীবীদের অনেকে একযোগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পাঁচ মিনিটে রায় ঘোষণা শেষ করে বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন এজলাস ছেড়ে যান। এরপর আদালত চত্বরে আইনজীবীরা মিছিল করে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

রায় ঘোষণার পর আসামিরা ছিলেন নির্বিকার। প্রধান আসামি নূর হোসেনকে আশপাশের আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে নূর হোসেন খাঁচার বাইরে থাকা তারেক সাঈদের সঙ্গে কথা বলেন।

পরে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘এ রায়ে আমরা খুশি। রাষ্ট্রপক্ষ সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আদালত সব আসামিকেই সাজা দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, নূর হোসেন তাঁর প্রতিপক্ষ কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য র‌্যাবের তারেক সাঈদসহ অন্যদের সহযোগিতা নেন। নূর হোসেনের সঙ্গে র‌্যাবের এসব কর্মকর্তার আর্থিক সম্পর্ক ছিল অনেক দিনের। সেই সুবাদে নূর হোসেন র‌্যাবের এসব কর্মকর্তার সহযোগিতায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটান।
এজলাসে উপস্থিত ছিলেন রানার শাশুড়ি ও তারেক সাঈদের বাবা মুজিবুর রহমান। তাঁরা কেউ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কিছু বলতে রাজি হননি। তবে নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম রায়ের পরপর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। এখন চাই দ্রুত রায় কার্যকর হোক।’

কী ঘটেছিল সেদিন
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র‌্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামায়। র‌্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তাঁর তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময়ে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাঁকে ও তাঁর গাড়িচালককেও র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনায় র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্ততার তথ্য প্রকাশ পায়, টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। তারেক সাঈদ ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা হওয়ায় বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়।

একই সময়ে ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত নূর হোসেনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের একটি টেলিকথোপকথন প্রকাশ পায়। যাতে নূর হোসেন ভারতে পালাতে শামীম ওসমানের সহায়তা চান। এরপর নূর হোসেন পালিয়ে যান ভারতে।

এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে নজরুলের অনুসারীরা ও এলাকাবাসী। গণমাধ্যমে ও সারা দেশে বিষয়টি হয়ে ওঠে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু।

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনমামলা ও বিচার

এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটির বাদী নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং অপরটির বাদী আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। হাইকোর্টের নির্দেশে র‌্যাবের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। তার আগে তিনজনকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত নেওয়া হয় এবং তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল র‌্যাবের ২৫ জন (চাকরিচ্যুত) কর্মকর্তা, সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। শুরু হয় বিচারকাজ। সাত মাসে ৩৮ কর্মদিবসে মামলার কার্যক্রম ও শুনানি চলে। এরপর গত বছরের ৩০ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন।

এই রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, এই রায়ে আবার প্রমাণিত হলো, সরকার যদি চায়, তাহলে বিচার সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। সরকার চেয়েছে বলেই সাত খুনের মতো জটিল মামলা ৩৩ মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আর সরকার চায়নি, তাই চার বছরেও ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ এই রায়ে খুশি। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন আশা করে, মেধাবী ছাত্র ত্বকী, আশিক, ভুলু, চঞ্চল হত্যারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। (প্রথম আলো)

নিউজ ডেস্ক
।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ১০ : ১০ এএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ মঙ্গলবার
ডিএইচ

Leave a Reply