Home / জাতীয় / নানামুখি দ্বন্দ্বে বাস্তবায়ন হচ্ছে না উপজেলা পরিষদ আইন
gov-2

নানামুখি দ্বন্দ্বে বাস্তবায়ন হচ্ছে না উপজেলা পরিষদ আইন

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৩: ৫৬ অপরাহ্ন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বুধবার

রাজনীতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে স্থানীয় সরকার আইন বাস্তবায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রাধান্য পেলেও বাস্তবে এ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নানামুখী দ্বন্দ্বের কারণে বাস্তবায়নও হচ্ছে না উপজেলা পরিষদ আইন। অথচ সরকারের বিভিন্ন আইন ও দলিলে নীতিগতভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে। ফলে বেশিরভাগ উপজেলার সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারছে না।

তবে সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের ১৭টি দপ্তরে কর্মরত জনবলের বেতন-ভাতা ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের দেওয়া অর্থ সরাসরি উপজেলা পরিষদে জমা হওয়ার মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে সহায়ক হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম প্রক্রিয়া হলো- স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সেবা সংস্থার কার্যক্রমগুলোকে সরাসরি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ন্যস্ত করা। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবেই এসবের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা। সে উদ্দেশ্যে বিদ্যমান উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ আইনে বেশকিছু সরকারি সেবা কার্যক্রম সংস্থা দু’টির হাতে ন্যস্ত থাকলেও প্রকৃত অর্থে তা কার্যকরী হচ্ছে না।

সরকারি সেবা কার্যক্রমগুলো পরিষদের কাছে ন্যস্ত না করার ফলে উপজেলা ব্যবস্থা পুনরায় চালু হলেও নির্বাচিত পরিষদ হিসেবে তা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। যথাযথ সম্পদ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব না থাকার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান হলেও চাহিদা মাফিক সেবা প্রদান করতে পারছে না বলেও অভিযোগ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের।

উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) এর ২৪ ধারা ও তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী ১৭টি সরকারি দপ্তর উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। দপ্তরগুলো হলো- সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, তার অধীনস্থ কর্মচারী ও কার্যাবলী), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর, সমাজ সেবা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।

বিগত সময়ে এসব দপ্তরগুলোকে উপজেলা পরিষদে ‘হস্তান্তরিত’ বলা হলেও তা সরাসরি উপজেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত না হয়ে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় বা বিভাগের শাখা হিসেবে কাজ করছে। এ কারণেই কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে স্ব স্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। এ কারণেই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন বা দেখভাল করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত পরিষদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। ফলে আইন ও বাস্তবতার মধ্যে তফাত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের অবস্থা আরো শোচনীয়।

এখনেও আইনগতভাবে (ধারা ৬৪) ৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমগুলো ‘হস্তান্তরযোগ্য’ বলা হলেও তাও উপজেলা পরিষদের মতো ‘হস্তান্তরিত’ নয়। যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা, মৎস্য ও পশুসম্পদ, সামাজিক কল্যাণ প্রভৃতি। ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে এ কার্যক্রমগুলোর সম্পর্ক যথাযথভাবে নির্ধারিত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও অস্পষ্ট অবস্থান থেকে সঠিকভাবে যার যার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে উপজেলা পরিষদ আইন করা হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী ও কার্যকর করা সংবিধানেও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। অথচ তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো সরকারেরই উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই আইন বাস্তবায়ন করা না গেলে এটি অকার্যকর হয়ে যাবে।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব পরিষদের নির্বাহী কমিটিগুলো কার্যকরী নয়। এ কারণে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা তাদের জবাবদিহি করতে পারেন না। অন্যদিকে আইনে তোয়াক্কা না করে সময়ে সময়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র জারি করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়। পাশাপাশি, রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতার অভাব, আমলাতান্ত্রিকতা এ অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে।’

জানা গেছে, এরশাদ সরকারের আমলে উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়। এরপর সর্বশেষ ২০০৯ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ১৯৯৮ সালে এ আইন সংশোধনের সময় উপদেষ্টা হিসেবে সংসদ সদস্যদের পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ইউপি সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন থেকে উপজেলা পরিষদ এবং এর আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করছে ওয়েভ ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনগত দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

তারা বলছেন, আইন ও প্রজ্ঞাপনগুলোর মধ্যকার অসামঞ্জস্যগুলো দূর করা; সরকারের বিভিন্ন সেক্টোরাল পলিসির সঙ্গে স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত নীতি ও আইনের সামঞ্জস্য বিধান; স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিশেষত উপজেলা পরিষদের ওপর কেন্দ্রীয় রাজনীতিক (সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা) নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, উপজেলা পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনবল বৃদ্ধি ও অধীনস্থ সরকারি কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব প্রদান, সর্বোপরি সরকারের রাজনীতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ

ত ৩১ আগস্ট মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগের উত্থাপিত প্রস্তাব অনুযায়ী উপজেলায় অবস্থিত ১৭টি দপ্তরে কর্মরত জনবলের বেতন-ভাতা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের দেওয়া অর্থ সরাসরি উপজেলা পরিষদে জমা হওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে উপজেলা পরিষদের যেকোনো অর্থ খরচ করতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যৌথ সইয়ের প্রয়োজন হবে। আইনে উল্লেখিত হস্তান্তরিত বিভাগ সংক্রান্ত বিধান কার্যকরী করার মাধ্যমে দেরিতে হলেও অগ্রগতির লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে উল্লিখিত দপ্তরসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা আরো বৃদ্ধি পাবে, যা সার্বিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখবে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে গভার্নেন্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী মহসিন আলী বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ আইন রয়েছে। এটা খারাপ না। কিন্তু এতে এমপিদের বাধ্যতামূলক উপদেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে তারা প্রভাব খাটায়। সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের ১৭টি দপ্তরের অর্থ উপজেলা পরিষদকে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা এই আইনের জন্য ইতিবাচক। আইনটি কার্যকর করতে হলে আরো কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে কাজের জবাবদিহীতা ও মনিটরিংয়ের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আইন থাকলেও উপজেলা পরিষদে এখন দ্বৈতনীতি চলছে। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা উপজেলাকে দেওয়া হলে ভালো হয়। এ আইনে বাজেট প্রণয়নের কথা থাকলে উপজেলা বাজেট প্রণয়ন এখনো ভালোভাবে হয়নি। উপজেলা স্টান্ডিং কমিটিগুলোও ভালো কার্যকর নেই। এই কমিটিগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। স্থানীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতা কার্যকর করা গেলেই শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ গঠিত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার সীমাবদ্ধতার কারণেই প্রতিটি সরকার উপজেলা পরিষদ নিয়ে ভাবেনা বলেও মন্তব্য এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞের।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫