Home / উপজেলা সংবাদ / হাজীগঞ্জ / চাঁদপুরের গর্ব শহীদ এমদাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিকথা
চাঁদপুরের গর্ব শহীদ এমদাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিকথা
নাসির কোট শহীদদের সমাধিস্থল

চাঁদপুরের গর্ব শহীদ এমদাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিকথা

আজকের বাংলাদেশ তথা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পাক-হায়নাদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সোনালি প্রান্তর। এদের মধ্যে যুব-কিশোর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান তুলনা রহিত।

অত্যাচারী পাক-বাহিনীর স্টীম রোলারের মধ্যেও ধমিয়ে থাকেনি যুবা-কিশোররা। প্রতিবাদের বাণী উচ্চ শিখরে উচিঁয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাঁড়া দিয়ে আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে রণাঙ্গনে।

মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করে আমাদেরকে এনে দিয়েছে সবুজের বুকে রক্ত মাখা লাল-সবুজের পতাকা। এ পতাকাটির কারণে বিশ্ব দরবারে গর্বিত বাঙালি হিসেবে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারছি। এ পরিচয়ের পেছনে জড়িয়ে রয়েছে শহীদের রক্ত মা-বোনদের সম্ভ্রম।

কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বীপ্ত শপথে মিলেছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রাণ চাঞ্চল্য একজন কিশোর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এমদাদ। ৯জন বীর শহীদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এমদাদ। ১৫ বছর বয়সে যুদ্ধ যাত্রা করেছিল এমদাদ। তার পুরো নাম এমদাদুল হক মোল্লা।

চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বর্তমান ৬নং বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের সেন্দ্রা মোল্লা বাড়ির তৎকালিন মুসলিম লীগ সমর্থক মরহুম ফজলুল হক মাস্টারের ছেলে। ভগ্নিপতি মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুর রহমানের সাথে ঢাকায় থাকতেন। সেখানেই চলে মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা।

সবে মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। রাজধানী শহর জুড়ে মিটিং মিছিলে ব্যস্ত সময় পার করছে ছাত্র জনতা। চারিদিকে পাক-বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বাংলা মায়ের সন্তানরা। ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত পিপাসু পাক হায়নারা।

কিশোর এমমদাদ ভগ্নিপতি লুৎফুর রহমানের সাথে গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এসে স্থীর হয়ে থাকতে পারেনি; পাক-হায়নাদের অত্যাচারের লেলিহান শিখায় টগবগ করছে যৌবনের বাঁধন। এ বাঁধন ভাংতে গিয়েও পিতার আদেশকে অমান্য করতে বাধ্য হয় এমমদাদ।

মাত্র দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় দেশ মাতৃকার স্বার্থে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে প্রথমে বাবার কাছে অনুমতি চাইল; কিন্তু বাবা ফজলুল হক সে পথে বিচলিত নয়, দেশদ্রোহীদের পক্ষপাতিত্ব করেন। এমদাদকে বারণ করেন যেন যুদ্ধের কথা মুখে না আনে।

এদিকে রাজধানী শহরে পাক বাহিনীর নির্মম নিগ্রহের ছাত্র জনতার প্রতিবাদ দেখে বসে থাকতে পারেনি কিশোর এমদাদ। চটপট করতে থাকে কিশোর অবুঝ মন।

পিতা ফজলুল হক স্বদেশ বিরোধী আচরণে ক্ষীপ্ত হয়ে এমদাদ বলে উঠে, ‘পাক বাহিনীর আগে আপনাকে হত্যা করা উচিত! দেশের প্রতি আপনার ভালবাসা নেই। আমি যদি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসি তবে আগে আপনাকে হত্যা করবো।’

কিশোর কণ্ঠের ঝাঁঝানো প্রতিবাদ এমদাদের হৃদয়ে যুদ্ধের ধামাকা বেজে ওঠে। জন্মদাতার দেশপ্রেমের বিরুদ্দাচরণ থেকে ক্ষান্ত হয়নি, শান্ত কন্ঠে বজ্রের মত গর্জে ওঠে তীক্ষ্ম ধ্বনি। সর্বশেষ বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের যাত্রা করে। মাত্র পনের বছর বয়সে একাত্তরের রণাঙ্গনে পাড়ি জমিয়েছেন।

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মুক্তি বাহিনীর হাত ধরে প্রথমে ট্রেনিং করে। ট্রেনিং শেষে স্থান হয় বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেটওয়ার্কি ঘাঁটি নাসিরকোট গ্রামে। সেখান থেকে নির্দেশনা নিয়ে কিশোর এমমাদ সহযোদ্ধাদের সাঙ্গ হিসেবে শত্রুর মোকাবেলা করতে শিখে।

১৯৭১সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামের যুদ্ধে পাক বাহিনীর বুলেটের আঘাতে অস্তমিত হয় এমদাদের জীবচ্ছবি। শহীদ হওয়ার পর এমদাদের মৃতদেহ মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে আসে নাসিরকোট যুদ্ধ ঘাঁটিতে। সেখানে সমাহিত করা হয় শহীদ এমদাদের নিথর দেহ।

কিশোর শহীদ এমদাদের দেশ প্রেমের কথাটি জানতে পারি শহীদ এমদাদ স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শহীদ এমদাদের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা ও ৬নং বড়কুল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি অবসর প্রাপ্ত মেলিটারী মফিজুল ইসলামে কাছে।

তনি সেদিন তুলে ধরেন এমদাদের বাল্য স্মৃতি ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিময় কাব্য। অল্প বয়সের বিশাল কল্পনায় আজ স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমিতে আমরা বাঙালি হিসেবে বিশ্বের দরবারে ঠাঁই পাচ্ছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এমদাদ নবযুগের প্রেরণা। তার প্রাণের বিনিময়ে আমাদের দেশ প্রেমের অনুভূতি প্রসারিত করছে।

বিশ্ব কবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বয়সের ছেলেদের বালাই বলেছেন, নজরুলের ধূমকেতু ধ্বংসের প্রতীক, ও যেন সৃষ্টির প্রেরণা। নাসিরকোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধের সমাধীস্থলে ৯জন শহীদের মধ্যে এমদাদের বয়স ছিল কম। কিশোর বয়সে নিথর দেহকে দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে মুক্তির ধাম উচ্চাঙ্গ তরঙ্গে রাঙ্গা ধুলিতে রঞ্জিত করে গেছেন। এ যেন আমরা পাওনা চাইতে গিয়ে দেনার পরিমাণ বেশি হয়ে রয়েছি।

যে বালাই কিশোর “স্বাধীনতা শব্দটি খুঁজতে যাবার পূর্বক্ষণে পিতার প্রতি অসন্তুষ্টি ও নিষ্ফল প্রসঙ্গে কণ্ঠরুদ্ধ করতে পারেনি, বেজে উঠেছে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো বর্জের গর্জন।

পিতার স্বদেশ বিরুদ্ধাচরণের পরও এমদাদ মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নিজ পিতার মুখে শত্রুর প্রশংসায় ক্ষীপ্ত কণ্ঠে দ্ব্যার্থহীন জবাবে, স্বাধীনা ফিরে পাবার পর যদি ফিরে আসে তবে যেন জন্মদাতাকে নিজ হস্তে বধ করবে।

একাত্তরের আর ক’জন যুবকের মধ্যে এমদাদের প্রতীয়মান দেশ প্রেমের আমূল রত্ন। এ কিশোর এমদাদ নব যুগের প্রেরণা। যুগে যুগে বহু যুব-কিশোর অতিবাহিত হবে বটে! কিন্ত এমদাদের দেশ প্রেম জাগ্রত হবে না।

এমদারের বাড়ি ফেরা হয়নি, স্থান হয়েছে শহীদ ব্যাধিতে।

চাঁদপুরের গর্ব শহীদ এমদাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিকথা

লেখক:গাজী মহিনউদ্দিন তরুণ সংবাদকর্মী, হাজীগঞ্জ
অধ্যয়নরত: চাঁদপুর সরকারি কলেজ (বাংলা বিভাগ)
ইমেইল: pressmohin@gmail.com

Leave a Reply