Home / বিশেষ সংবাদ / গোপনে ‘পাত্রী’ দেখতে গেলেই বিপদ
গোপনে ‘পাত্রী’ দেখতে গেলেই বিপদ

গোপনে ‘পাত্রী’ দেখতে গেলেই বিপদ

১৭ মার্চ- বছর দুয়েক আগে ‘পাত্র চাই’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে লেখা ছিল—‘সপরিবারে স্পেনের সিটিজেনশিপ। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে (৩৪) বন্ধ্যার কারণে ডিভোর্স।

যে কোনো জেলার মধ্যবিত্ত পরিবারের ৪০ উর্ধের পাত্র।’ ভাষা-ব্যাকরণের শুদ্ধতার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। কারণ এ প্রতিবেদনের বিষয় তা নয়। বিজ্ঞাপনটি ঠিক এভাবেই ছাপা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৩ মার্চ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি রাজধানীর দক্ষিণখানের পূর্ব সরদারপাড়ার বাসিন্দা আলমগীর হোসেনের চোখে পড়ে। উল্লিখিত মুঠোফোন নাম্বারে কল করেন তিনি।

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠ, ‘আমিই পাত্রী। আমার নাম লিজা। বিয়ে হলে আপনাকে স্পেনে নিয়ে যাব।’ ওই দিনই আলমগীরকে মধ্যবাড্ডার লিংক রোডের পানসি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলে লিজা। কথামতো সেখানে গিয়েই বিপাকে পড়েন তিনি। লিজা ও তার স্বজনরা তাঁকে বলেন, স্পেনে যেতে হলে ২২ লাখ টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়;

একপর্যায় আলমগীরকে আটকে মারধর করে লিজার সহযোগীরা। তাঁর মানিব্যাগ ও মুঠোফোন কেড়ে নেয় ওরা। খালি হাতে বাড়ি ফেরেন তিনি। তার পরও বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন, এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন আলমগীর হোসেন। লজ্জায় কাউকে কিছু বলেননি তিনি। মাস দেড়েক পর সংবাদপত্রে ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারকচক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তারের খবর চোখে পড়ে তাঁর। ছবি দেখে তিনি চিনতে পারেন, এরাই হামলা করেছিল তাঁর ওপর। তিনি ছুটে যান গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে।

সেখানে গিয়ে হতবাক আলমগীর, যাকে লিজা বলে জেনেছেন, সেই তরুণীর নাম আসলে জেসমিন আক্তার ওরফে লোচনী; বয়স ২৮ বছর। ডিবির কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, জেসমিন নাম বদলে বিয়ের পাত্রী সেজে কাঙ্ক্ষিত পাত্রের সামনে হাজির হয়। বিয়ের আগেই পাত্রের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয় সে। বিয়ের নামে প্রতারণাই তার পেশা।

কখনো বিয়েও করে, তবে সেটা সাজানো। চক্রে পুরুষ সদস্যও রয়েছে। পাত্রীর ভূমিকা পালনের জন্য হাতিয়ে নেওয়া টাকার ভাগ পায় জেসমিন। চক্রে সাবেকুন্নাহার টপি (২৮) ও শাহনাজ পারভিন মুন্নি (২৯) নামের আরো দুই নারী আছে। ওই দুজনকেও গ্রেপ্তার করে ডিবি। অনুসন্ধানে রাজধানীতে ওই তিন নারীর মতো অর্ধশত ভুয়া পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে। তারা সবাই ম্যারেজ মিডিয়ার হয়ে কাজ করে। কেউ কেউ একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করে। হাতিয়ে নেওয়া টাকার কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ পায় ভুয়া পাত্রীরা।

কখনো মাসিক বেতনেও কাজ করে তারা। গত সাত বছরে দুই ডজন প্রতারকচক্রের ৩০ জন নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। তবে তাদের কেউ এখন জেলে নেই। জামিনে বেরিয়ে গেছে তারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, এই নারীরা সুন্দরী ও চতুর। পাত্রী সেজে প্রতারণা করাই তাদের পেশা। প্রবাসী, ধনীর দুলালী, অভিজাত এলাকাবাসিনী, গাড়ি-বাড়িওয়ালি, ডিভোর্সি, ধার্মিক বোরকাওয়ালি—যখন যেমন প্রয়োজন তেমন বেশ ধারণে সক্ষম তারা।

বিদেশ যেতে আগ্রহী পাত্ররা যোগাযোগ করলে প্রতারকচক্র তাঁদের ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট ও রূপসী পাত্রীর ছবি দেখায়; চাইলে পাত্রীদের হাজিরও করা হয়। এরপর বিপাকে ফেলে সম্ভাব্য পাত্রের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। কার্যসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অফিস ও বাসা বদলে ফেলে প্রতারকরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায়ই অভিযান চালিয়ে ম্যারেজ মিডিয়ার নামে প্রতারণাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার মূল কাজটি করে মেয়েরা—পাত্রী সেজে। এমন কিছু নারীকে আমরা আইনের আওতায় এনেছি।’ গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ‘প্রবাসী পাত্রীর জন্য পাত্র চাই’, ‘বিদেশে যেতে আগ্রহী সৎ পাত্র চাই’, ‘বিদেশে বসবাসকারী পাত্রীর জন্য সুপাত্র চাই’, ‘আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর পাত্র’—এমন নজরকাড়া বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে প্রলোভন দেখায় প্রতারকরা।

নারী সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে পাত্রের আর্থিক অবস্থা জানার চেষ্টা করে তারা। ভাড়াটে নারীদের কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সুন্দরী পাত্রী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। প্রতারণার অভিযোগে গত বছরের ২৩ জুন রাজধানীর কাকলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘ঘটক করিম ভাই’ ও ‘রাহবার ম্যারেজ মিডিয়া’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এই চক্রের সদস্য নওরিন জাহান (৩০), শামীমা আক্তার (২৫) ও কাকলি আক্তার (২৫)। তারাও গ্রেপ্তার হয়। শামীমা ও কাকলি বিয়ের পাত্রী সাজত, আর নওরিন দাপ্তরিক কাজ করত। সম্প্রতি এই তরুণীরা জামিনে ছাড়া পেয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়া জেসমিন আক্তার লোচনী এখন টঙ্গীর তালতলা বাজার এলাকায় থাকে। যশোরের ঝিকরগাছার রায়শাচাঁদপুরের ডুমুরিয়া গ্রামের মৃত আমির আলী মণ্ডলের মেয়ে সে। সাবেকুন্নাহার টপির সর্বশেষ অবস্থান ছিল উত্তরার উত্তর খালপাড়ে। নরসিংদীর মনোহরদীর চালাকচরের পীরপুর গ্রামের মাজহারুল ইসলামের মেয়ে সে। তাদের ভাড়ায় খাটাত হামিদ; সে আগেও তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছে। গাজীপুরের কলমেশ্বরের (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে) মৃত আব্দুস সালামের ছেলে সে। হামিদের প্রধান সহযোগী নাসির সর্বশেষ খিলক্ষেতের উত্তর নামাপাড়ায় ছিল। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কদমতলীর মৃত হামিদ মিয়ার ছেলে সে। আরো কিছু ভুয়া পাত্রীর খবর : আসমাউল হুসনা মিশুর (২৪) সর্বশেষ ঠিকানা মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি/এ ব্লকে। সে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বুড়িচং গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে। সাদিয়া মিতু (২৬) থাকে রামপুরার ডিআইটি প্রজেক্টের বিসিএস অ্যাপারেলস অ্যাপার্টমেন্টে।

মৃত আবুল বাশারের মেয়ে সে; স্থায়ী ঠিকানা সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায়। তার মা পরে লিয়ন নামের এক ঘটক-প্রতারককে বিয়ে করেন। সত্বাবার প্রতারণার কাজে সংশ্লিষ্ট সে। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের রামপুরের ইদ্রিস আলীর মেয়ে শায়লা শারমীন (৩৬) থাকে রামপুরার কে-ব্লকে। সালমা বেগম (২৮) বরিশালের মুলাদীর কিলমাপাড়ার জয়নাল আবেদীনের মেয়ে। তার সর্বশেষ অবস্থান ছিল পূর্ব রামপুরায়। শিলা (২৮) থাকে কালাচাঁদপুরে। সে গাজীপুরের জয়দেবপুরের শিববাড়ীর মৃত জামাল উদ্দিনের মেয়ে। সূত্র জানায়, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, খিলক্ষেত, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় সক্রিয় একটি প্রতারকচক্রের হোতা এরশাদ আলী। কুমিল্লার হোমনার আলীপুরা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সে, থাকে রাজধানীর সবুজবাগের ক-২ রোডের একটি বাড়িতে। তার সহযোগী আলমগীর হোসেন বাদশা থাকে মধ্যবাড্ডার সাহাবুদ্দিন মোড় এলাকায়। তাদের গ্রুপে কয়েকজন ভুয়া পাত্রী রয়েছে।

পূর্ব রামপুরার ইরানী (২৫), মিরপুরের সোমা (২৮) ও উত্তরার লাবনী (২৮) স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে প্রতারকচক্রের হয়ে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্রতারকচক্রের হয়ে কাজ করে ডালিয়া (৩০), নদী (২৫), সাথী (২৫), তৃষ্ণা (২৬), ডেইজী (২৭), মুন্নি (২৭) ও তিশা (২৮)। ডিবির পরিদর্শক রইসউদ্দিন বলেন, ‘দুটি চক্রের সদস্যদের ধরার পর অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। ভুয়া পাত্রীরা প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকার কমপক্ষের এক-চতুর্থাংশ পায়। অফিস ভাড়া, বিজ্ঞাপন দেওয়া ও অন্যান্য খরচ পুরুষ সহযোগীদের।’ আরো কিছু চক্রের কথা : ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রতারণার অভিযোগে উত্তরা থেকে ইফফাত জেরিন খান স্বর্ণা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পরই পাত্রী সেজে প্রতারণার বিষয়টি প্রথম প্রশাসনের নজরে আসে।

স্বর্ণার সহযোগী সাগর ও সজীব এখনো সক্রিয়। তাদের দলে আরো কয়েকজন নারী আছে। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি লালমাটিয়ার এ-ব্লকের ২/১ নম্বর বাড়ি থেকে ‘দেশ বাংলা মিডিয়ার’ ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ চক্রের প্রধান ‘পাত্রী’ শায়লা হক ওরফে মোনালিসা ওরফে মনা। জামিনে মুক্ত হয়ে সে প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে আবার প্রতারণা করছে বলে দাবি করেছে সূত্র।

নয়াপল্টনের ৫০-ডি আল মনসুর ভবনে অফিস খুলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে রুহুল আমীন মৃধা নামের এক ঘটক। এ চক্রে আছে শাম্মী আক্তার ও সালমা বেগম নামের দুই ভাড়াটে পাত্রী। আব্দুল হামিদ, রুহুল মৃধা, নাজমুল, ইমতিয়াজ, খোরশেদ ও উজ্জলের চক্র রামপুরা-বনশ্রী ও কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় প্রতারণা করে।

তাদের দলে আছে ভুয়া পাত্রী মায়া বেগম ও রানু রশিদ। সোহেল, তমাল, তাজুল, সুমন ও তারেকের চক্র মগবাজারের মিজান টাওয়ার থেকে ‘প্রিয়াংকা ম্যারেজ মিডিয়া’ সরিয়ে নিয়েছে। তাদের দলে আছে লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করা নাজমা ওয়াহিদ ইসলাম রোজি ও নিশু আক্তার নামের দুই নারী। নিউ মার্কেটে সাখাওয়াত হোসেন ও আবুল কালাম আজাদের প্রতারকচক্রে কাজ করে রাবেয়া খাতুন হেলেন। গুলশানের নিকেতনে সক্রিয় রয়েছে হৃদিতা জামান ও শাহনাজ পারভীন।

উত্তরায় হাফিজুর, মহিউদ্দিন মাসুদ, মানিক মিয়া ও কিবরিয়া চালায় একটি চক্র। তাদের দলে রয়েছে পারুল আক্তার, শামসুন্নাহার, নাজমা বেগম ও হেনা আক্তার। এক বছর আগে তারা ৫ নাম্বার সেক্টরের ৫/এ রোডের ৯ নাম্বার বাড়ির অস্থায়ী কার্যালয়টি সরিয়ে নিয়েছে। – (কালের কণ্ঠ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট ০৭:১৪ এএম, ২০ মার্চ ২০১৬, রোববার
ডিএইচ