Home / আন্তর্জাতিক / মুসলিমদের সাথে কাদিয়ানিদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন
মুসলিমদের সাথে কাদিয়ানিদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন
দিল্লিতে আহমদীয়া তথা কাদিয়ানি সমাজের প্রধান কেন্দ্র বাইতুল হাদি মসজিদ

মুসলিমদের সাথে কাদিয়ানিদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন

ভারতে কাদিয়ানি সম্প্রদায় সরকারিভাবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদেরই একটি শাখা হিসেবে স্বীকৃত – কিন্তু ভারতে মুসলিম সমাজের মূল স্রোতে তারা পুরোপুরি মিশে আছেন এ কথা কেউই বলবেন না। বিবিসির প্রতিবেদনটিতে কাদিয়ানিদেরকে আহমদীয়া সমাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবিসির ওই প্রতিবেদনের বলা হয়, ভারতে কাদিয়ানিরা সদ্য যে ঈদ পালন করে উঠলেন, সেটা ছিল একান্তই তাদের নিজস্ব উৎসব – সেখানে সুন্নি বা শিয়াদের কোনও যোগদান ছিল না।
ভারতের অত্যন্ত প্রভাবশালী ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডে’ও কাদিয়ানিদের কোনও সদস্য নেই।

ভারতের বেশ কয়েক লক্ষ কাদিয়ানি কাগজে-কলমে মুসলিম হয়েও কীভাবে একটি নি:সঙ্গ সম্প্রদায় হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন, দিল্লিতে কাদিয়ানিদের মূল কেন্দ্র বাইতুল হাদি মসজিদে গিয়ে নিচ্ছিলাম তারই খোঁজখবর।

ঈদের ঠিক আগে দিল্লিতে কাদিয়ানিরা আয়োজন করেছিলেন একটি জলসা বা ধর্মীয় সভা। তাদের এই ধরনের সভায় প্রায়ই হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রীষ্টান ধর্মের নেতারা আমন্ত্রিত হয়ে আসেন, কিন্তু সুন্নি বা শিয়া নেতাদের কখনওই সে জলসায় চোখে পড়ে না।

কাগজে-কলমে মুসলিম, বাস্তবে নন
আসলে ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েক লক্ষ কাদিয়ানি সরকারি নথিতে মুসলিম হয়েও সেই অর্থে এখনও মুসলিম সমাজের অংশ হয়ে উঠতে পারেননি একেবারেই। অথচ তাদের ধর্মীয় উৎসব একেবারেই অন্য মুসলিমদের মতো – বলছিলেন জম্মুর উধমপুর থেকে দিল্লিতে আসা কাদিয়ানি যুবক শফির ভাট।

তার কথায়, “দেখুন, নবীর নির্দেশিত পথেই আমরা ঈদ পালন করি, খুব সাদামাটাভাবে। কিন্তু শিয়া বা সুন্নিরা যেহেতু আমাদের কাফের বা বিধর্মী বলে মনে করে, তাই কখনও আমরা তাদের সঙ্গে মিলে ঈদ পালন করি না। আমরা শুধু আমাদের সেন্টার বা মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করি, অন্যদের মসজিদে যাই না।”

বছরপাঁচেক আগে দিল্লিতে এই কাদিয়ানিদের একটি কোরান প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল জামা মসজিদের ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারির প্রতিবাদে ।

ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, যারা দেশে ইসলামী আইনের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে, সেই কমিটিতেও কখনও জায়গা পাননি কাদিয়ানিরা।

তবে দিল্লিতে কাদিয়ানি জামাতের প্রেসিডেন্ট শফিক আহমেদ বলছিলেন, এগুলো তারা গায়ে মাখেন না।

তিনি বলছেন, “দেখুন আমরা ধরে নিই আমাদের যখন ওই বোর্ডে সামিল করা হয়নি, তখন নিশ্চয় আমাদের ভালর জন্যই সেটা হয়েছে। আর মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার কথাই যদি ওঠে, তাহলে অনেকেই কিন্তু জানেন না ইন্ডিয়ান মুসলীম লীগেরই মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কাদিয়ানিদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা মির্জা বশিরউদ্দিন আহমেদ।”
কিন্তু আজও কেন ভারতের শিয়া-সুন্নিরা কখনও ভুলেও কাদিয়ানিদের মসজিদে নামাজ পড়তে যান না? অথবা ঘটে না উল্টোটাও?

ভারতের রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন ইতিহাসবিদ কিংশুক চ্যাটার্জি, তিনি বলছেন, “এটা আসলে ‘অ্যাকালচারাশেন’ বা দুটো সংস্কৃতির সংঘাত। মেইনফ্রেম শিয়া বা সুন্নি কমিউনিটির মধ্যে কাদিয়ানিদের যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে এটা তারই প্রতিফলন, এর বাইরে কিছু নয়।”

“কাদিয়ানি কাল্টের যেটা প্রধান বক্তব্য সেটা হল মহম্মদই যে শেষ নবী – তা কিন্তু নয়। একই ধরনের বক্তব্য শিয়াদের সেক্ট বাহাইদের মধ্যেও আছে। বস্তুত কাদিয়ানি আর বাহাই, দুটো সেক্টই হল একই ভাবাদর্শের দুটো ধরন”, বলছেন ড: চ্যাটার্জি।

অর্থাৎ ইরানে যেভাবে বাহাইদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল, অনেকটা সেই একই দশা দক্ষিণ এশিয়ার কাদিয়ানিদের।

“আসলে কী, যখনই বলা হচ্ছে একজন নবী আবার ফিরে আসতে পারেন, তখনই প্রশ্ন উঠবে তাকে কে চিহ্নিত করবে? এই জাতীয় আরও নানা প্রশ্ন কমিউনিটির ভেতরেই নানা অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করে।”

ঈদ একই রকম, ফারাক মতের
ভারতে পাঞ্জাবের কাদিয়ান থেকে যে দর্শনের জন্ম, সেই কাদিয়ানি মতাবলম্বীরা আজ ছড়িয়ে আছেন কাশ্মীর থেকে কলকাতা, কেরল থেকে ওড়িশা – দেশের সর্বত্র। তাদের ঈদ হয়তো কিছুটা নি:সঙ্গ – কিন্তু আনন্দের কোনও কমতি নেই তাতে।

“ঈদের দিন সকালেই নতুন কাপড় পরে, কিছু না-খেয়ে সবাই সোজা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেন। ইমামসাহেবের খুতবার পর যারা কুরবানি দেবেন, তারা কুরবানি দিতে চলে যান। এই ঈদে বিরিয়ানি ও নোন্তা খাবার দাবারই বেশি রান্না করা হয়, সেমাই বা মিষ্টি বেশি হয় ছোটা ঈদ, অর্থাৎ রোজার পরের ঈদে”, কাশ্মীরি যুবক শফির বর্ণনা দেন তাদের ঈদের।

উৎসবের এই সব অনুষঙ্গ একেবারেই এক – তারপরেও কিন্তু কাদিয়ানিরা আজও একাত্ম হতে পারেননি ভারতের অন্য মুসলিমদের সাথে।

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামে গ্রামে কাদিয়ানি ভাবধারা প্রচার করে আসছেন আবু তাহের মন্ডল, আর তিনি এজন্য দায়ী করছেন পরস্পরের না-জানাকে।

“যদি সত্যিই আমাদের আত্মীকরণ হত, তাহলে তো মতানৈক্য থাকত না। মতানৈক্য হচ্ছে চিন্তাভাবনার অভাবে। জামায়াতে কাদিয়ানির যারা বিরোধিতা করেন, তারা শুধু তাদের মতের সঙ্গে আমাদের মেলে না বলেই বিরোধিতা করেন”, বেশ আক্ষেপের সঙ্গেই বলছিলেন আবু তাহের মন্ডল।

ভারতে কাদিয়ানিরা সম্ভবত একমাত্র ধর্মীয় সেক্ট, যাদের একটি চব্বিশ ঘন্টার হেল্পলাইন আছে, যেখানে ফোন করলেই মিলবে নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা।

কিন্তু মুসলিম সমাজের মূল স্রোতে তাদের মিশতে সাহায্য করবে, ভারতের কাদিয়ানিরা আজও সন্ধান পাননি তেমন কোনও হেল্পলাইনের।

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪:০০ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শনিবার
ডিএইচ

Leave a Reply