Home / জাতীয় / ‘কর্মক্ষম জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগের কর্মসংস্থান নেই’
‘কর্মক্ষম জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগের কর্মসংস্থান নেই’
ছবিসূত্র- বিবিসি

‘কর্মক্ষম জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগের কর্মসংস্থান নেই’

দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগেরই নিয়মিত কর্মসংস্থান নেই। বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী সরকারি চাকরিতে আগ্রহী। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইদুর রহমান সম্রাট ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন। এ পর্যন্ত চারবার বিসিএস পরীক্ষা দিলেও এখনও সফল হতে পারেননি। তবে হাল ছাড়ছেন না। সরকারী চাকরি পাবার বয়স-সীমা অতিক্রম না করা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন মি: সম্রাট।

বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হওয়া তার একটি স্বপ্ন। এর বাইরে আপাতত কিছু ভাবছেন না মি: সম্রাট।

তার মতো বাংলাদেশে এ ধরনের লক্ষ-লক্ষ তরুণ প্রতি বছর চাকরির বাজারে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৮ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসছে।

এদের মধ্যে গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রতিবছর কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। দেশের ভেতরে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট তারা সরকারী-বেসরকারি চাকুরীর দিকেই বেশি মনোযোগী। আর যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই অথবা ডিগ্রীধারী নন তাদের মধ্যেও একটি বড় অংশ চাকরী প্রত্যাশী। আবার অনেক আছেন ছোট খাটো ব্যবসাসহ নানা ধরনের স্ব-কর্মসংস্থানে জড়িত।

স্ব-কর্মসংস্থানে জড়িত হয়ে সফলতার গল্প বাংলাদেশে অনেক আছে। ঢাকার ব্যস্ত একটি রাস্তার পাশে ভ্যানে করে কফি বিক্রি করেন সারওয়ার আলম। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তিনি রাস্তার পাশে কফি বিক্রি করেন। বিক্রি বেশ ভালো। মাস্টার্স পাশ করা সারওয়ার আলম গত তিন বছর ধরে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য এটি বেছে নিয়েছেন। কেন তিনি এ পেশায় আসলেন?

মি: সারওয়ার বলেন, ” আমি এক সময় একটা প্রতিস্ঠানে চাকরি করতাম। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই কিছু একটা করবো। আমার স্বপ্ন হচ্ছে, এখান থেকে শুরু করে বড় ধরনের একটি কফি শপের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা। যেমন গ্লোরিয়া জিনস। ”

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারত্ব সাড়ে তিন শতাংশ। অর্থাৎ যারা সপ্তাহ অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করেছেন । এছাড়া কর্মক্ষেত্র নিয়ে সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র বৈজ্ঞানিক জরিপ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

এ জরিপ বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদ ড: মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, বাংলাদেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগের নিয়মিত কোন কর্মসংস্থান নেই।
ড: রহমান বলেন, যখন সার্ভে করা হয় সে সময়টিতে কেউ সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করেছেন কিনা সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়। তখন দেখা যায় যে অনেকে হয়তো সে সময়টিতে হয়তো কিছু কাজ করেছেন কিন্তু সারা বছর হয়তো কাজ করেন না। সেজন্য বেকারত্বের হার চার শতাংশ বলা হয়। তবে এর পরিমাণ কিছুটা বেশি হতে পারে বলে ড: রহমানের ধারণা।

ড: রহমান বলছেন, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বাজারে ২১ শতাংশ আন্ডার-এমপ্লয়েড বা পূর্ণকালীন কাজ করেন না।
” সবটা মিলিয়ে আমরা যদি আন্ডারএমপ্লয়েড এবং আন-এমপ্লয়েড মিলিয়ে আমাদের শতকরা ২৫ ভাগ কাজ করেন না , বা অল্প সময়ে কাজ করেন, টুকটাক কাজ করেন, সিজনাল কাজ করেন,” বলছিলেন ড: রহমান।
বাংলাদেশ সরকারের হিসেবে দেশে শ্রম বাজারে যারা এসেছেন তাদের প্রায় ৭৮ শতাংশ হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। অর্থাৎ এদের কোন নিয়োগপত্র নেই এবং কাজের কোন স্থায়িত্বও নেই। এদের কেউ কৃষিক্ষেত্রে, কেউবা দিনমজুর আবার কেউবা পরিবহন শ্রমিক কিংবা নানা ধরনের পেশা। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষি এবং নানাখাতে অর্থনীতির ভাষায় ছদ্ম-বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। অর্থাৎ যে কাজ দু’জন করলে যথেষ্ট, সে কাজ চারজন মিলে করছে। অতিরিক্ত দু’জন না থাকলেও উৎপাদনের কোন সমস্যা হবেনা। অর্থনীতিতে এ বাড়তি জনশক্তির কোন অবদান না থাকলেও পরিসংখ্যানের বিচারে তারা বেকার নয়। বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক কৌশল এবং নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে পরিকল্পনা কমিশন। প্রতি বছর যে পরিমাণ মানুষ কাজের বাজারে আসছে তাদের জন্য সে সুযোগ কতটা তৈরি হচ্ছে? পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড: শামসুল আলম বলছেন ২০১১ সালে থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান আশাব্যঞ্জক।

ড: আলম জানালেন, ” ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) এক কোটি ৪০ লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। এ সময়ের মধ্যে প্রতিবছর দেশের বাইরে গিয়েছে গড়ে পাঁচ লক্ষ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কর্ম বাজারে প্রবেশ মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছদ্ম বেকারত্ব। যে কাজের উপযুক্ত, সে হয়তো সে কাজটি পাচ্ছে না।”
কিন্তু কর্মসংস্থানের বাজারে যারা আসছেন, তাদের বেশিরভাগ সারওয়ার আলমের মতো স্ব-কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার চেয়ে চাকরীর করতেই বেশি পছন্দ করেন। অনেক মনে করেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কোন কাজে তারা জড়িত হতে চান না । তাছাড়া পরিবার থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিনিয়োগ করতেও অনেকে ভয় পান।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন ছাত্র বলছিলেন, ” আমি যখন পড়াশুনা করেছি তখন আমার এবং আমার পরিবারের একটা আশা ছিল যে ভালো একটা চাকরী করবো। যতদিন চাকরী না পাই ততদিন ট্রাই করে যাব। আশা করি পেয়ে যাব।”
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বেকারত্ব বেশি। যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই তারা কোন না কোন কর্মসংস্থানে নিজেদের জড়িত রেখেছেন। সেটি নিম্ন মজুরীতে হলেও। কিন্তু শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও শিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়াটা অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য একটি অশনি সংকেত। আসছে দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান।
ড: রহমান বলছিলেন, ” গত তিন দশকে আমরা শিক্ষার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করেছি। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৮ থেকে ২৯ বছরের তরুণ-তরুণীদের মাঝে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের একটা আকাঙ্ক্ষা আছে। তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তা না হলে শিক্ষার জন্য আমরা যে বিনিয়োগ করেছি সেটার সুফল পাওয়া যাবে না।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বাজারে এক ধরনের বৈপরীত্য দেখা যায়। একদিকে অনেকেই বেকার থাকছে আবার অন্যদিকে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে এ বিষয়গুলো কিভাবে সমাধান করা যায় সে চিন্তা এবং কৌশল তারা প্রণয়ন করছেন। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড: শামসুল আলম বলেন, সরকার যে ধরনের অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করছে তাতে সামনের দিনগুলোতে শিল্প এবং সেবা-খাতের বিকাশ হবে। ফলে শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাকরীর বাজার বড় হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড: শামসুল আলম বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে মধ্যে এক কোটি ২৯ লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের বাজের আসবে ৯৯ লক্ষ মানুষ। ফলে কর্মসংস্থানের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। শিল্প এবং সেবা খাতের আরো বিকাশ হবে বলে আমরা আশা করছি। ফলে মজুরীও বাড়বে

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশের শ্রম বাজারের যেদিকে যাচ্ছে তাতে করে এখন সেবা খাতের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বেশি দরকার। শ্রম বাজারের সম্প্রসারণের সাথে-সাথে আসছে দিনগুলোতে ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পাবে বলে তারা মনে করেন। কিন্তু টেকনিক্যাল এন্ড ভোকেশনাল বা টিবেট শিক্ষার ক্ষেত্রে কতটা আগ্রহী হচ্ছে তরুণরা? কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থার কারিগরি শিক্ষা বিষয়ক প্রধান শাহজাহান মিয়া বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে এখন শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেশ বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দক্ষতা-নির্ভর এবং বিশেষায়িত জ্ঞান নিয়ে তরুণরা নিজেদের তৈরি করলে ভালো বেতনের চাকরী তেমন কোন সমস্যা হবে না। কারণ বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে শ্রম বাজার সে ইংগিত দিচ্ছে। (বিবিসি)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৬: ০০ পিএম, ০৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার
ডিএইচ

Leave a Reply