Home / শিল্প-সাহিত্য / একজন মা-মেয়ের মোবাইল কথপোকথন
mobile hearing
প্রতীকী ছবি

একজন মা-মেয়ের মোবাইল কথপোকথন

: আসসালামু আলাইকুম ।

: ওয়াআলাইকুম আসসালাম । কেমন আছ সোনা ।

: মা তুমি ফোন করেছ !!! আমাদের এখানে তো এখনো রাত, মা তুমি রাখ আমি কল করছি ।

: হ্যালো মা কেমন আছ ? ফোন করেছ কেন মা ?

: তুমি তো প্রতি শনিবারে ফোন করো কিন্তু গতকাল তুমি ফোন করনি, রাত ১০ টা পর্যন্ত আমি আশায় ছিলাম কিন্তু তুমি ফোন করনি , সারা রাত আমার ঘুম হয়নি ফজর নামাজ পড়েই তোমার আব্বাকে বল্লাম লায়লাকে একটু ফোন দিয়ে দাও ।

: তোমরা কেমন আছ সোনা ?

: আলহামদুল্লিলাহ ! আমরা ভাল আছি মা ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন দিতে পারি নাই। তুমি এত চিন্তা কর না তো মা আমরা ভাল আছি ।

: মারে, ছেলে মেয়ে দুরে থাকলে মায়ের মন যে নানা বিপদ আপদের ভয়ে কত দূর্বল থাকে সেটা তো তুমি বুঝ না তোমরা তিন ভাই বোনই দেশের বাহিরে আমি যে কত দুঃচিন্তায় থাকি সেটা তোমরা বুঝবা কি ভাবে !! নাইশা,নাইম ,জামাই কেমন আছে রে মা ।

: আলহামদুল্লিলাহ ! সবাই ভাল আছে মা ,আব্বার শরীর কেমন ?

: আলহামদুল্লিলাহ ! তোমার আব্বার ডায়েবেটিস ,প্রেসার গত সপ্তাহে একটু বেড়েছিল এখন ঠিক আছে । তোমরা দেশে আসবা না ?

: মা এটা তো ঢাকা- সিলেট না যে মন চাইল আর চলে আসলাম ।নাইশা,নাইমের পড়াশুনা ,তোমার জামাই এর কাজ আমার কাজ ,সবার এক সাথে সময় মিলানো যায় না মা ।

: হু সবই বুঝি রে মা কিন্তু মন তো বুঝে না ,কতদিন হয়ে গেল তোমার মুখটা দেখি না ।নাইশাকে বিয়ে দিবা না ?

: জী মা দিব , ১৮ বছর হলেই বিয়ে দিয়ে দিব তখন ওর কলেজ ও শেষ হবে। বিয়ের পর ইউনির্ভাসিটিতে পড়বে । ওর কলেজ শেষ হতে আরো দুই বছর বাকি আছে ।

: হু তোমার আব্বার বয়স হয়ে গিয়েছে তা ছাড়া বিভিন্ন রোগে ও ধরেছে , নাইশা বড় নাতনী ওকে বিয়ে দিয়ে তোমার আব্বাকে দেখিয়ে দাও ।

: জী মা দুয়া কর আর একটা ভাল ছেলের খোঁজ কর আমরা দুই বছর পর এসে বিয়ে দিব ।

: আর ও দুই বছর !! অতদিন কি বাঁচবরে সোনা !!

: কেন বাঁচবা না আর মা তুমি কাঁদছ কেন !! আমরা তো এখানে ভাল আছি , সবদিক থেকেই আমরা ভাল আছি, খাওয়া ,পরা কোনটাতেই সমস্যা নেই এখানে ।

: হু রে সোনা তোমরা ভাল আছ ,ভাল খাও ভাল পর জানি কিন্তু আমি তো দেখি না ।ছেলে মেয়ে বুকে নিয়ে আছ তো বুঝ না ,ছেলে মেয়ে দুরে থাকলে মায়ের কেমন কষ্ট হয় ।

: মা তুমি কেঁদ না তো , আমাদের জন্য দুয়া কর ।মা আজকের মত রাখি মা ।

: ঠিক আছে আবার ফোন দিও সোনা ।

: ওকে মা আল্লাহ হাফেজ ।

: আল্লাহ হাফেজ ।

নাইশার কলেজ শেষ হওয়ার আগেই লায়লা মেয়ের জন্য একটা ভাল ছেলের সন্ধান পান । ছেলে মেডিসিনে থার্ড ইয়ার পড়ে ।ছেলের বাবা, মা চান ছেলেকে এখনই বিয়ে দিতে । ফিনল্যান্ডে ছেলের খালা লায়লার সাথে একই আফিসে কাজ করে ।তিনিই প্রথম নাইশাকে দেখে বিয়ের প্রস্তাব দেন ।

ছেলের পরিবার ইংল্যান্ডে সেটেল্ট ছেলের জন্ম ওখানেই ।ছেলের মা, বাবা নাইশাকে দেখে খুব পছন্দ করে তাই তারা চান নাওর বিয়ের পর ইংল্যান্ডে ইউনির্ভারসিটি শুরু করুন ।

লায়লাও তার স্বামী খুব খুশী ।দুই পরিবার মিলে নাওরের পরিক্ষার পর স্যামারের ছুটিতে দেশে যেয়ে বিয়ের অনুষ্টান করবে কথা পাকা হয়ে থাকে ।

আর মাত্র কয়েকটা মাস বাকী । লায়লা এখান থেকে যা কিছু কেনা দরকার সে গুলো গুচ্ছাছে । দেশে কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দেয়া হয়েছে , বিয়ের কার্ড ও রেডী হয়েছে ।

লায়লা ফোনে মা,বাবা জানিয়ে দেয় তোমরা আস্তে আস্তে কার্ডগুলো বিলি শুরু করে , আমরা এসে তো বেশী সময় পাব না , তাছাড়া কেনা কাটা তো অনেক করতে হবে ।

সব কিছু সুন্দর ভাবেই চলছিল কিন্তু লায়লার মা হঠাৎ ষ্টোক করে মারা যান ।লায়লার এক নজর দেখার ভাগ্য হয়নি ।

কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না, হয়ত কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় ঠিকই পর মূহুর্তেই আবার সবাই আগের মতই শুরু করে ।

লায়লা ও মাকে ছাড়াই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ,মেয়ে জামাই নিয়ে ফিনল্যান্ড চলে এসেছে । এখানে মেয়ে জামাই ২ সপ্তাহ বেড়িয়ে লন্ডন চলে যাবে ।

দেখতে দেখতে ২ সপ্তাহ পার হয়ে যায় ।সারা দিন কাজের মাঝে ও লায়লার মনটা ছটফট করতে থাকে কালকেই মেয়েটা চলে যাবে , রাতে বিছানায় যেয়ে লায়লার বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘ নিঃস্বাস সাথে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে রাত পোহালেই মেয়েটা চলে যাবে !! সারা রাত লায়লার ঘুম আসে না চোখটা বুঝলেই বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে রাত পোহালেই মেয়েটা চলে যাবে ———–!!

লায়লার মনে পড়ে, আমার যখন প্রথম বিয়ে হল শুশুর বাড়ি যাওয়ার দিন আমার মা বলত আজকে সারা রাত ঘুম হয়নি ——তাহলে আমার মায়ের ও কি এমন কষ্টই হত !!

মেয়েটা চলে যাবার পর কোথা থেকে যেন নানা দূর্চিন্তা মাথায় এসে ভর করেছে । মেয়েটা ওদের খাবার খেতে পারছে তো ,ও তো কখনো রান্না করেনি ও পারবে তো, গরম পাতিলে হাত দিয়ে ওর হাত পুড়ে গেল নাত , হাত কেটে গেল নাত এসব নানা চিন্তা মাথায় আসে ।

নাইশার ইউনির্ভারসিটিতে ক্লাস শুরু হয়েছে । সারাদিন ক্লাস শেষে বিকালে ঘরে টুকটাক কাজ ও স্বামীর সাথে সময় কাটিয়ে নাইশা মায়ের সাথে কথা বলার সময় করতে পারে না ।অবশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় অল্প হলেও একবার করে কথা হয় মা মেয়েতে ।

প্রতিদের মত আজকেও লায়লা মেয়েকে ভাইবারে কল দেয় কিন্তু ও পাশ থেকে কেউ রিসিপ করে না —— এক বার —— দুই বার ——তিনবার কল দেয় না কেউ রিসিপ করে না । স্কাইপে যায় সেখানে অফলাইন ।

লায়লার কেমন যেন অস্তির লাগে ,হায় আল্লাহ !! কি হল !! আমি এখন কি করব সারা রাত এক রকম ছটফট করতে করতে লায়লার রাত শেষ হয় ।

সকালে কাজে এসে ও স্থির হতে পারছে না মেয়েকে ফোন দেয় —০০০০০০০০০ হ্যালো ,আসসালামু আলাইকুম ।

: ওয়াআলাইকুম আসসালাম । কেমন আছ সোনা মনি ?

: আলহামদুল্লিলাহ ! আম্মু আমি ভাল আছি , তুমি এত সকালে ফোন করেছ কেন ?

: ও তোমাদের সময় তো আমাদের চেয়ে দুইঘন্টা পিছনে সরি সোনা। মারে কালকে বিকালে তোমার সাথে কথা হয় নি , তোমাকে কয়েকবার ফোন দিলাম তুমি ধরনি চিন্তায় আমার সারা রাত ঘুম হয়নি । তোমার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কোন শান্তি পাচ্ছিলাম না তাই সোনা ।

: আম্মু এত চিন্তা কর নাতো আমরা ভাল আছি । কালকে বিকালে একটু বাহিরে গিয়েছিলাম মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছিলাম । বাসায় এসে তোমার মিসকল দেখেছি কিন্তু তোমার অনেক রাত ছিল তাই আর ফোন দেয়া হয় নি ।তুমি এত চিন্তা কর না আম্মু কিছু হলে তো জানাবই ।

: চিন্তা কর না বল্লেই কি হয় —- মাতো হও নাই মায়ের মন বুঝবা কি ভাবে !!

: ওকে আম্মু এখন রেখে দিলাম পরে কথা হবে ।

: ওকে সোনা মনি আল্লাহ হাফেয ।

ফোনটা রেখে লায়লার চেহারাটা আরো ম্লান হয়ে যায় ।মার কথা খুব মনে পড়ছে আমার মাতো এমনি করেই আমাকে বলত আমি তো তখন মায়ের উপর বিরক্ত হতাম ।

মা ফোন দিলেই বলত কবে আসবা , কতদিন তোমার মুখটা দেখি না ।

শেষ যেদিন মায়ের সাথে কথা হয় মা বলেছিল সোনা আমি দিন গুনতেছি আর পথের দিকে তাকাই আছি তুমি আসবা ।আমার মায়ের দিন গুনা আর শেষ হয় নাই ।

লায়লার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে ।

————–

লায়লার ছেলে নাইম ভাল রেজাল্ড করে কলেজ শেষ করে । পরিবারের সবার কাক্ষিত সাবজেক্টে চান্স ও পায় তবে লায়লারা যে শহরে থাকে সেখান থেকে একটু দুরে অন্য একটা শহরে ।

ছেলের কৃতিত্বে মায়ের চেয়ে আর বেশী খুশী কে হয়, লায়লাও অনেক খুশী হয়েছে কিন্তু ছেলে এক মাস পর চলে যাবে মনে হতেই লায়লার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠে ।

সারাক্ষণ নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করে , মেয়েটা স্বামী , শুশুর শাশুরীর সাথে থাকে একটু চিন্তা কমই ছিল । ছেলেটা একা থাকতে পারবে তো রাতে ভয় পাবে না ,রান্না করতে পারতে তো , চুলা বন্ধ করতে মনে থাকবে তো !!আরো অনেক অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরেই থাকে । এর ই মাঝে লায়লা ছেলের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনে গুছাতে ও থাকে ।

নাইম চলে যাচ্ছে ———-লায়লা ছেলেকে জড়িয়ে কান্না করছে , নাইম মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আম্মু তুমি কেদঁনা কিন্তু নাইম ও আর কথা বলতে পারে না চুপ করেই বেড়িয়ে যায় ।

লায়লার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে , নিজেকে খুবই একা ও নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ,দুইটা মাত্র সন্তান দুইজনই দুরে চলে গেল , এত তাড়াতাড়ি সন্তান ছাড়া হয়ে গেলাম ।

মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ,লায়লা ডুকুরে কেঁদে উঠে , আর বলে মা আজকে তোমাকে খুব মনে পড়ছে কিন্তু মা তুমি বলেছিলে সন্তান দুরে থাকলে মায়ের যে কষ্ট হয় , তোমার সে কষ্টের কথা মনে করে তোমাকে মনে পড়ছে না ,বিস্বাস কর মা আমার সন্তানদের জন্য কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে , খুব অশান্তি লাগছে শুধু মনে হচ্ছে এখন যদি আমি তোমার বুকে মাথা রাখতে পারতাম তাহলে আমি কিছুটা হলে ও শান্তি পেতাম ।

মা আমি ও তোমার মত ধাপে ধাপে তোমার সব অবস্থান গুলো পার করছি , কিন্তু মা তোমার কষ্ট বুঝলেও তোমার কষ্ট কে তোমার মত করে অনুধাবন করতে পারছি না মা কারন আমার কাছে আমার কষ্টটাই বড় মনে হচ্ছে ।

সূত্র : টুডে ব্লাগ, লিখেছেন আফরা, আপডেট ১০ মার্চ, ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ