Home / বিশেষ সংবাদ / কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা !
নির্বাচন কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা

কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা !

কেমন হতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা ।
নির্বাচন কমিশন গঠনের পর নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথাটি ক্ষমতাসীন দল থেকে সম্ভবত প্রথম আলোচনায় আনলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেছেন, ‘যিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী আছেন, তাঁর অধীনেই নির্বাচন হবে।’ অনেকেরই ধারণা, এটুকু অন্তত বাস্তবতা। বিএনপি যা-ই বলুক বা করুক, তারা এই বাস্তবতা মেনেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমরা মোহাম্মদ নাসিমের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রসঙ্গটি প্রচলিত আইন ও সংবিধানের আওতায় বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। যদিও নির্বাচন কমিশন গঠনে একটা আইনের কথা বলা থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সংবিধানে সরাসরি কিছু বলা নেই। তবে ব্রিটেনের মতো দেশ কিন্তু নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার হাত-পা বেঁধে দিতে একটি লিখিত কনভেনশন করে নিয়েছে। নতুন ইসির হিম্মত থাকলে এ রকম একটি কনভেনশনে সই করাতে সরকারকে রাজি করানোর উদ্যোগ নিক। দ্য কেবিনেট ম্যানুয়াল অ্যান্ড দ্য কেয়ারটেকার কনভেনশন নিয়ে ব্রিটেনের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আমরাও তার আলোকে রুলস অব বিজনেসে যথা পরিবর্তন এনে একটি নির্বাচনী সরকারের ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

মোহাম্মদ নাসিম একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর সেটি হলো, তিনি উল্লেখ করেছেন, আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিধান আছে। শুক্রবারের প্রথম আলোর এক অনলাইন প্রতিবেদনে নাসিমের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি ইচ্ছা করেন, মনে করেন, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন। যেটা সংবিধানে আছে। যাঁদের নিয়ে করার ইচ্ছা, তিনি তা-ই করবেন।’ আমাদের মতে, সংবিধানেই সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করার বিধান আছে।

নির্বাচনকালীন সরকার তা আওয়ামী লীগ বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা বিএনপি বর্ণিত সহায়ক সরকার বা অন্য যে নামই দেওয়া হোক না কেন, এই সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে রাষ্ট্রপতির উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাঁর সুমহান মর্যাদাকে ব্যবহার করতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনারদের বাছাইয়ে যেভাবে অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে; ঠিক সেই ধরনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করার সুযোগ হয়তো নেই। তবে গণ–অনুসন্ধান করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে অন্তত সংবিধান পথরোধ করে দাঁড়াবে না।

অনেকেরই ধারণায় নেই যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানেই কিন্তু একটি নির্বাচনী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই বিধানটি সংবিধানে এখনো টিকে আছে এবং এটি সবার অগোচরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ঐকমতে্য আনা দ্বাদশ সংশোধনীতে সংবিধানে ঢুকেছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলে যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ধারা সূচিত হয়েছিল, তা আর দুর্বল হয়নি। ক্রমান্বয়ে সবল হয়েছে। সে কারণে কখনোই এই অনুচ্ছেদগুলোর দিকে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে নজরদারি করার সুযোগ পায়নি। ইতিহাসে এবারই আমরা প্রথম উল্লেখযোগ্য সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পেরেছি।

এখন আমরা সংবিধানের আওতায় অথচ সবারই নজরদারির মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সক্রিয় চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারি। এবার যেভাবে বেলা শেষে নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে পরিহার করা যেতে পারে।

সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। এবং প্রধানমন্ত্রী সময়-সময় যেরূপ স্থির করবেন, সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। শুধু এই অনুচ্ছেদটির দিকে তাকালে দেখা যায়, মন্ত্রী নিয়োগে রাষ্ট্রপতির বুঝি কোনো জায়গা নেই। সংবিধান বুঝি তাঁকে রিক্ত বা নিঃস্ব করেছে। কিন্তু বিষয়টি মোটেই তা নয়। প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগদাতা রাষ্ট্রপতি। এরপর আমরা ৫৬(১) অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিলেও দেখব, সেখানে লেখা : ‘একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করবেন, সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকবেন।’ কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের নিয়োগ দেবেন।

সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ তাই বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করবেন।’ সুতরাং নির্বাচন কমিশনার ও মন্ত্রী নিয়োগের মধ্যে তফাত হলো, সংবিধান পরোক্ষভাবে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। আর এখানে সংবিধান সরাসরি বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। নির্বাচনী কমিশন গঠনে আইনের কথা বলেছে। কিন্তু নির্বাচনী মন্ত্রিসভা করতে আইন করার বালাই নেই। সংবিধান নির্দিষ্ট করে ও সরাসরি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করবেন, সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী থাকবেন। আবার বলেছে, ‘সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করবেন, সেরূপ একটি মন্ত্রীসভা থাকবে।’ তার মানে দাঁড়াল, যে ৩১টি রাজনৈতিক দল ইসি গঠনে বঙ্গভবনে গিয়েছিল, তারা এবারে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠনে গণভবনে যেতে পারে।

জাতীয় ঐক্য ও মেলবন্ধন তৈরির ক্ষেত্রে এত তিক্ততা ও বাদানুবাদ থাকা সত্ত্বেও একটি রাজনৈতিক অগ্রগতি হলো, ইতিহাসে এই প্রথম আওয়ামী লীগ বিএনপির তালিকা থেকে একজনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছে। পাঁচজনের কমিশনে একজন নেওয়ার অনুপাতে ত্রিশ সদস্যের কোনো ছোট মন্ত্রিসভায় বিএনপি ×ছয়টি পদ আশা করতে পারে। ৭১ বছর পরে হলেও ইতিহাসের না হয় খানিকটা পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের ১২ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগকে পাঁচটি দপ্তর (অর্থ, আইন, বাণিজ্য, ডাক ও স্বাস্থ্য) দেওয়া হয়েছিল।

মন্ত্রীর মতো নির্বাচন কমিশনারের পদ সাংবিধানিক। কমিশনাররা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ পেলেন। রাষ্ট্রপতি একজন দলীয় রাষ্ট্রপতি। এসব তথ্য ও আইনগত অবস্থা বিএনপির কাছে পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের পাঁচটি সাংবিধানিক পদের জন্য পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করতে দেখেছি।

সুতরাং সেই একই সংবিধানের আওতায় নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠনে অন্তত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে বিএনপিকে অন্তত পাঁচটি নাম প্রস্তাব করতে দেখলে আমাদের আর যাই হোক পিলে চমকাবে না। যদিও এ কথা সত্য, বিএনপি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বলেনি যে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের দাবি পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং তারা নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিতে গিয়ে কী অবস্থা গ্রহণ করে, সেটা একটা দেখার বিষয়।

রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান একটি বড় প্রশ্ন। সে কৌশলগত কারণে তারা সহায়ক সরকারের ধারণাপত্র উপস্থাপন যেটা করতে যাচ্ছে, তাতে তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচনে যাবে, সে কথা হয়তো তারা পরিষ্কার করবে না। এটা উহ্য রাখলে তারা সরকারি দলকে চাপে রাখতে পারবে। সুতরাং তাদের প্রস্তাবিত সহায়ক সরকার বরং নিরপেক্ষ হতে হবে, এই জোরটাই তারা দেবে। এবং এটাও সত্য, প্রক্রিয়া যতই বেদনাদায়ক হোক, আমরা নিজেদের সভ্য জাতিতে পরিণত করতে চাইলে দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের নির্বাচনকালে পক্ষপাতমুক্ত চরিত্র অর্জন করতে হবে। এই বর্তমান দলীয় মন্ত্রিসভাকেই আমাদের বদলে যেতে দেখতে হবে। জনগণ অবাক চোখে দেখবে মন্ত্রীদের কী হলো, তাঁরা সকলেই এতটা সংযত কেন। এটা কবে হবে জানি না। তবে এটাই হতে হবে।

গোড়াতে বলেছিলাম, বাহাত্তরের সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার যাতে করা যায়, সেই কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর সেটা লেখা হয়েছিল ৫৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপদফায়। বর্তমানেও এটি বহাল আছে। এতে লেখা আছে, ‘সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগে যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন, তাঁরা সাংসদ বলেই গণ্য হবেন।’

প্রতীয়মান হচ্ছে, বিএনপি সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের দাবি তুললে এই অনুচ্ছেদটির প্রয়োগযোগ্যতা আলোচনায় আসতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল সম্ভবত সংসদ ভেঙে সাধারণ নির্বাচনের দিকে কিছুতেই যাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীকে যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে সংবিধান যেরূপ স্থির করা বা নির্ধারণ করার নিরঙ্কুশ এখতিয়ার দিয়েছে, তাই তিনি চাইলে মন্ত্রী বাছাইয়ের যেকোনো সৃজনশীল পন্থা উদ্ভাবন করার এখতিয়ার রাখেন। চাইলে রাষ্ট্রপতির দপ্তরকেও ব্যবহার করতে পারেন। এমন কিছু করলে তাতে সংবিধান বাধা দেবে না। যদিও তাঁকে কেউ অবাস্তব, রেওয়াজবহির্ভূত বলতে পারেন। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এটা কোথায় আছে? তবে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাই এখানে সব থেকে বড়।

এ প্রসঙ্গে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে স্মরণ করতেই হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যখন নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছিল, তখন তিনি সংসদে তাঁর দপ্তরে আমাকে বলেছিলেন, বিএনপিকে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্রের মতো মন্ত্রণালয়গুলো দেওয়া যেতে পারে। গত ৩০ জানুয়ারি সবশেষ আমাকে নিজেই ফোন করে বিএনপিকে একজন কমিশনার দেওয়ার যে তথ্য দিয়েছিলেন, সেটা তো ফলেছে। এ কথাও আমরা মনে রাখব, তখন তো বিএনপি সংসদে ছিল। এখন নেই। কিন্তু টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর কোটা আছে, আসন খালি করে কাউকে উপনির্বাচনেও জিতিয়ে আনার পথ খোলা।

এখন কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নির্বাচনের কত দিন আগে কীভাবে কী করেন, আদৌ এবার করবেন কি না, সেটা বাংলাদেশ রাজনীতির বাস্তবতা সমর্থন করে কি না—সেসব ভিন্ন প্রশ্ন। বলতে চাই সমঝোতা ও ঐক্যটাই আসল, সংবিধান বাধা নয়। ইসি গঠনে আস্থার কোনো ঘাটতি হয়ে থাকলে তা পুষিয়ে নেওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে এতে বাধা দিলে রুগ্ণ রাজনীতিই দেবে। আপাতত মোহাম্মদ নাসিমের কণ্ঠে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্রেফ উচ্চারিত হওয়াকেই ইতিবাচক মনে হলো।প্রথমআলো

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:২০,পি.এম ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৭,সোমবার
ইব্রাহীম জুয়েল

Leave a Reply