Home / উপজেলা সংবাদ / শাহরাস্তি / শাহরাস্তির স্কুলছাত্রী মিনুর আত্মহত্যায় জড়িতরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে
শাহরাস্তির স্কুলছাত্রী মিনুর আত্মহত্যায় জড়িতরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

শাহরাস্তির স্কুলছাত্রী মিনুর আত্মহত্যায় জড়িতরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

বিদ্যালয়ে ও শ্রেনিকক্ষে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননককারী চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ফরিদউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনুর আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে।

ঘটনার ২ বছর অতিবাহিত হলেও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আইনি চোখ ফাঁকি দিয়ে বহালতবিয়তে রয়েছে মামলার মূল আসামী মমিন হোসেন তারেকসহ অন্যরা।

দফায় দফায় তদন্ত কার্যক্রম পরিবর্তন ও আসামী পক্ষের হুমকি-ধমকিতে বোন হারানোর বিচার চেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে মামলার বাদিপক্ষের।
২০১৫ সালের ২০ আগস্ট শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনু শ্রেনীকক্ষে ও বিরতির সময় ক্যাম্পাসে সহপাঠীর দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার ও উত্ত্যক্তকারীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নাজেহাল হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
কি ঘটেছিলো সে দিনঃ উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের পন্ডিত বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার মিনু। তাকে প্রায়ই প্রেম নিবেদন ও উত্যক্ত করতো সহপাঠী সংহাই গ্রামের প্রবাসী আবু তাহেরের ছেলে তারেক। তারেক কোনোভাবে মিনুকে পটাতে না পেরে মা রূপবান বেগম ও বোন কনিকাকে সহযোগিতা করতে বলে। এ ব্যপারে ঘটনার ৩ দিন আগে ১৭ আগস্ট ১৫ সোমবার বিকেলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেন সাহেবের নিকট শারমিনের ছোট ভাই নয়ন মৌখিক ভাবে একটি অভিযোগ দেয়। ২০ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে ইংরেজি ক্লাস চলাকালে রূপবান বেগম ক্লাসের ভেতর ঢুকে মিনুকে দাঁড় করায়। পরে তার ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। এ প্রস্তাব মিনু প্রত্যাখ্যান করলে তারা মিনুকে বিভিন্ন প্রকার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে বিরতির সময় রুপবান বেগমের সাথে তার মেয়ে কনিকা এসে আরো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। এসময় তারেক মিনুকে চড় মারে ও মুখে থুতু দেয়। উপস্থিত অন্যান্য সহপাঠিদের সামনে অপমানিত হয়ে রাগে ক্ষোভে ৪র্থ ঘন্টার পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় মিনু। এরপর তাদের বসতঘরের নিচ তলায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরিবারের সদস্যরা তাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
“আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কণিকা” মিনুর আত্মহননের পর তার ঘর হতে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে লিখা ছিলোঃ ‘মা, ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কণিকা। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ তোমরা নিও।’
প্রতারণা করে আসামীর জামিনঃ ঘটনার পর মিনুর বড় ভাই শাহাবুদ্দিন নয়ন ৫ জনের নাম উল্লেখ করে শাহরাস্তি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় শুধুমাত্র তারেককে গ্রেফতার করা হয়।

মিনুর ভাই ও মামলার বাদী শাহাবুদ্দিন নয়ন জানান, ধূর্ত তারেকের পরিবার অর্থের বিনিময়ে বয়স কমিয়ে ভুয়া জন্ম সনদ তৈরি করে। তাতে তারেকের বয়স দেখানো হয় ১৭ বছর ৫ মাস ১২ দিন। অথচ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসাপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি) ডাঃ এম মাঈন উদ্দিনের মেডিকেল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তারেকের বয়স ২০ বছর। এই ভুয়া জন্ম সনদ দ্বারা তারেককে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে ৩২ দিন কারাবাস শেষে প্রতারণামূলক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার জামিন নেয়া হয়। কিন্তু মিনুর আত্মহত্যায় প্রধান প্ররোচনাকারী বখাটে তারেকের মা রূপবান বেগম ও তার বোন কনিকা আজো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আসামীর পক্ষে সাফাই প্রধান শিক্ষকের, শারমীন আক্তার মিনুর আত্মহননের ৩ দিন পর লিখিত ভাবে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান পাটওয়ারী, তার প্রতিবেদনে ইভটিজিং কোন ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। ২৩ আগস্ট ২০১৫ তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলী আশ্রাফ খান এর নিকট নিকট এ প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তারেক, তার মা রুপবান বেগম ও বোন কনিকার অপরাধ আড়াল করে বিদ্যালয়ে ইভটিজিংয়ের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং শারমীন ও শারমীনের অভিভাবক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট ইভটিজিং অথবা কোন উশৃঙ্খল আচরণের জন্য তারেকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কোন লিখিত অভিযোগ দেয় নাই মর্মে উল্লেখ করা হয়।

ভিকটিমের পরিবার আরো জানায়, দক্ষিন সূচীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বখাটে আচরণের দায়ে বহিষ্কার হওয়া তারেককে কোন প্রকার টিসি ছাড়াই এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনায় অপরাধীকে বিদ্যালয় হতে বহিষ্কার না করে তার শিক্ষাজীবন অক্ষুন্ন রাখতে প্রধান শিক্ষকের প্রচেষ্টায় লাকসামের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।

শিক্ষকের অপরাধীদের সাথে এমন সখ্যতা ও অপরাধী পরিবারকে বাঁচাতে তার এসব কর্মকান্ডে একজন শিক্ষকের পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম নিয়েছে।
অভিযোগ পত্র প্রত্যাখ্যান আদালতেরঃ এ মামলায় শাহরাস্তি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মোঃ নিজাম উদ্দিন গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারেক ও তার মা রুপবান বেগমকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে। এতে মামলা থেকে ৩ জন আসামীর নাম বাদ দেয়া হয়। তারা হলো : মৃত আব্দুল জলিলের পুত্র তারেকের বন্ধু আবু রায়হান, ছালেহ আহমেদের পুত্র মোঃ শামীম হোসেন ও তারেকের বোন নুরুন্নাহার আক্তার কনিকা। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ এ অভিযোগ পত্রে তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত করেছেন মর্মে উক্ত চার্জশীটের উপর নারাজি আবেদন করেন বাদী। গত ১৬ মার্চ ২০১৬ নারাজি আবেদন মঞ্জুর হয়ে মামলাটি আদালত সিআইডিতে প্রেরণ করে। সিআইডি পুনঃ তদন্ত শেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আবারো তদন্তের নির্দেশ দেন। যা বর্তমানে তদন্তাধীন।
বাদীর পরিবারকে হুমকীঃ শারমিন আক্তার মিনুর ভাই মামলার বাদী শাহাবুদ্দিন জানান, জামিনে এসে তারেক ও তার মা তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারেক জামিন নিয়েছে, তার মা ও বোন প্রকাশ্যে ঘুরছে। তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, মামলা শেষ হয়ে গেছে, কোনো কিছুই হবে না। শাহাবুদ্দিন আরো জানান, নিজের বোন হারানোর ঘটনার বিচার চেয়ে নিজেই প্রাণ শংকায় রয়েছেন।
আজো পথ চেয়ে বসে থাকেন শহিদা বেগমঃ এদিকে এই ঘটনার ২ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো এর বিচার না হওয়ায় হতাশ মিনুর মা শাহিদা বেগম। তবে তিনি বিচার পাওয়ার আশায় রয়েছেন। সরেজমিনে হাঁড়িয়া গ্রামে মিনুর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মিনুর মায়ের সাথে। সংবাদকর্মীদের দেখেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমি রাস্তায় বের হই না, স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলে আমার কলিজা ফেটে যায়। বিকেল হলেই মনে হয় দলবাঁধা মেয়েদের সারি হতে ছুটে এসে স্কুল ব্যাগ খাটে ছুঁড়ে মিনু আমায় ডাকছে- “মা, খেতে দাও” সে আশায় আজো তার পথ চেয়ে আছি। আমি একটু বিচার চেয়েছি, তাও আজ এটা কাল ওটা। দোষীদের শাস্তি দেখলে আমার মিনুর আত্মা শান্তি পাবে। যাদের কারণে আমার মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো আমি তাদের বিচারের আশায় রয়েছি। মিনুর মৃত্যুর ঘটনায় চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার তাদের বাড়িতে ছুটে এসে সান্ত¡না দেয়ার কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাহিদা বেগম।
ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকার ব্যপক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও জামিনে এসে বখাটে তারেক ও অন্য আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরাফিরা ও বাদী পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নেয়ার হুমকি ক্ষীণ করে তুলছে মিনুর মায়ের বিচার পাওয়ার আশা। এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে স্থানীয়রা।

এ সংক্রান্ত আগের প্রতিবেদন

‘মা ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দিও আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী….’

মোঃ মাহবুব আলম, শাহরাস্তি
: আপডেট, বাংলাদেশ ৩: ০০ পিএম, ৬ আগস্ট ২০১৭, রোববার
ডিএইচ

Leave a Reply