Home / চাঁদপুর / লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ইলিশ উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা

লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ইলিশ উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা

নদ-নদীর দেশগুলোর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। দেশের এ নদ-নদীতে ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বাড়ছেই। এদেশে বহু প্রকারের মাছ রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশের অব¯’ান সর্বশীর্ষে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে মিঠা পানির উৎপাদনে বাংলাদেশের অব¯’ান ৪র্থ। দেশে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়েছ তার বর্তমান মূল্য হয়েছ ১০ হাজার কোটি টাকা।

এক তথ্যে জানা গেছে, ২০১৫-২০১৬ দেশে ৩ লাখ ৯৫ হাজার মে.টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি বছর ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ হলো-২০১১ হতে ২০১৬ পর্যন্ত ৭ হাজার ৫ শ’৪০ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ৩৩ হাজার ৬ শ’ ৩৫টি অভিযান পরিচালনা, ৫০ হাজার ৯ শ’ ৩৭ জনকে জেল জরিমানা ও ৮৮ কোটি ৭৮ লাখ মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দ করায় মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা পাওয়ায় ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

চলতি বছর ২০১৭-১৮ তে ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ রয়েছে ৪ লাখ মে.টন। মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত হলে ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অতীতকাল থেকেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং আমিষের চাহিদা পুরণে ইলিশ মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইলিশের অবদান ১২%।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ইলিশ উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা

ছবিটি চাঁদপুর মাছঘাট থেকে তোলা : পুরোনো ছবি- চাঁদপুর টাইমস

২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ৩ লাখ ৭৫ হাজার ইলিশ উৎপন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। ইলিশ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

বাংলাদেশের মাছ প্রধানত: দু’ভাগে বিভক্ত। এর একটি হলো লোনা পানির মাছ অপরটি হলো মিঠা পানির মাছ। আর দেশের জাতীয় মাছ হলো ইলিশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের সাম্প্রতিক তথ্য মতে,বিশ্বের ১১ টি দেশে ইলিশ রয়েছে।এর মধ্যে ১০টি দেশেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। আর বাংলাদেশে এর উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের ৬৫% ইলিশ বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে।

ইলিশ মাছ সাগরে বসবাস করে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই বংশ বিস্তারের জন্যে ডিম ছাড়ার সময় ১২শ’ কি.মি.পর্যন্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের মিঠা পানিতে প্রবেশ করে। একটি মা ইলিশ একবারে ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। যার ৯৮% ইলিশের রেণুতে পরিণত হয়ে খাদ্যের প্রয়োজনে উজানে চলে আসে। উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির ভেতর থাকে প্লাংটন নামক এক প্রকার বালু কণিকা যা তাদের খাদ্য।

চাঁদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে জানান,‘চলতি ২০১৭-’১৮ অর্থবছরে দেশের সকল ইলিশ উৎসসমূহে ৪ লাখ মে.টন ইলিশ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান।’ জাটকা রক্ষা কর্মসুচি, মা মাছ সংরক্ষণে অভয়াশ্রম সুরক্ষা বিদ্যমান থাকলে এ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।

প্রতি বছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৫ শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই এ মাছের চাহিদা রয়েছে। কেননা এটি একটি সু-স্বাদু মাছ। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়ে থাকে তার ৬৫% বাংলাদেশে,২০% ভারতে, ৫% মায়ানমারে এবং বাকি ৫% ভাগ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় । প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের দেশের নদ-নদীগুলোতে ইলিশের বিচরণ রয়েছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ বিভিন্ন সময় স্বাদু পানি, লবণাক্ত ও আধা লবণাক্ত পরিবেশে কাটায়। তবে ডিম পাড়ার সময় হলে বঙ্গোপসাগড়ের মেঘনা মোহনায় এসে স্বাদু বা মিঠা পানিতে প্রবেশ করে। ডিম ছেড়ে পুনরায় লবণাক্ত পানিতে চলে যায়। এটি ইলিশের জীবনধারা ।

প্রতি বছর এক জোড়া পুর্ণাঙ্গ ইলিশ একবারে ১০-২০ লাখ ডিম ছাড়ে। এর ৯৮ ভাগই ইলিশের রেণুতে পরিণত হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে ক্রমশ উজানে প্রবেশ করে। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘনা নদী নিম্নভাগ,সাহাবাজপুর,কুয়াকাটা,ঢালচর,আন্দারমানিক প্রভৃতি।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ইলিশ উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা
এসব স্থানকে মৎস্য বিজ্ঞানীরা ইলিশ প্রজনন মৌসুমে অভয়াশ্রম বলে থাকি। দেশের বিভিন্নস্থানে ডিম ছাড়ার পর রেণুতে পরিণত হওয়া সময়কে ইলিশের জাটকা বলা হয়। একটু বড় হলে জেলেরা স্থানীয় ভাষায় বলে থাকে ‘টেম্পু ইলিশ।’

প্রতি বছর জাটকা মাছগুলো ইলিশে পরণিত হওয়ার সময় দেশেরই নদ-নদীর তীরবর্তী এক শ্রেণির জেলেরা দিন বা রাতের বেলায় এক প্রকার ছোট ব্যাসের ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল’ দিয়ে ঐ ইলিশের জাটকাগুলো ধরে ফেলে।

প্রতি বছর যে পরিমাণ জাটকা ওইসব জেলেদের জালে ধরা হয় তার প্রতিটির ওজন ১০ গ্রাম করে বিবেচনা করলে প্রতি বছর ১৯ হাজার মে.টন জাটকাই এসব জেলেরা ধরছে। যার সংখ্যায় যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৪৮ লাখ। এর ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইলিশের জাটকা রক্ষা করা সম্ভব হলে বছরে আরও কয়েক লাখ মে.টন ইলিশ উৎপাদন করা সম্ভব।

নদী গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১৫ টি জেলায় ৮৫ টি উপজেলায় ইলিশ উৎপদনের ভেতর অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এতে জেলের সংখ্যা প্রায় পৌনে ২ লাখ। যার গড় হার মাত্র ২ ভাগ। এ ২ ভাগ জেলে জীবন বাঁচানোর নামে আমাদের জাতীয় সম্পদ ইলিশের বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।

জাতীয় আয়ের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বছরের অক্টোবরের ১৫ দিন ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার মৌসুম। এ সময় দেশের প্রধান প্রধান ইলিশ মাছের বিচরণগুলোতে ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হলে ইলিশ উৎপাদন অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে বলে ইলিশ গবেষকরা দাবি করেছেন।

সরকার নির্দিষ্ট ব্যাসের কারেন্ট জালের উৎপাদন ব্যবহার,মজুদ ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা স্বত্ত্বেও কোন ফাঁকে পুনরায় তৃণমূল পর্যায়ে জেলেদের হাতে ওই জাল চলে আসে। ।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ইলিশ উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা

ফাইল ছবি

এছাড়াও ওই জাল দিয়ে শিকার করা সে জাটকাগুলো আবার নদী পথেই দেশের বিভিন্ন শহর, নগর,বন্দর এমনকি রাজধানী শহরে চলে যাচ্ছে। এ সব কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধিই পাবে । ২০০২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইলিশ উৎপাদন বাড়ছেই ।

এ বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি জোরদার করা ও অভয়াশ্রমগুলোতে মা মাছ আহোরণ বন্ধ রাখা। প্রতি বছর গড়ে প্রায় আড়াই থেকে ৫শ’ কোটি টাকা ইলিশ রপ্তানি খাতে আয় হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ইলিশ প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহোরণ সম্পূর্ণ বন্ধ,জাটকা রক্ষা কর্মসূচি যথযথভাবে পালন,স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান,সদস্য ও গ্রাম পুলিশদের প্রতি কড়া নির্দেশ,কোনো অবস্থাতেই নৌ-সড়ক পথে জাটকা বাজারজাত করতে না দেয়া, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনী সদস্যদের মোতায়েন করা,স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধারণা প্রদান, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ইলিশ মাছ রক্ষায় আন্তরিকতা, জেলেদের পূনর্বাসনের ক্ষেত্রে প্রকৃত জেলেদের সহায়তা, ইলিশ আহরিত এলাকায় র‌্যাবের টহল জোরদার বা ইলিশ উৎপাদিত এলাকাগুলোর বিশেষ বিশেষ স্থানে সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন, সরকারি-বেসরকারি চাকুরীজীবীরা জাটকরা ক্রয় থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে নজর দিলে প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশ উৎপাদন দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে।‎

এ দিকে চাঁদপুরের উত্তর সীমানায় মতলবের ষাটনল পর্যন্ত ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর দুর্গন্ধময়,দূষণ ও আর্বজনাযুক্ত পানি মেঘনায় প্রবেশ করা শুরু করেছে ।

এ বিষয়ে দেশের সকল বিশেষজ্ঞ,আনবিক শক্তি কমিশন ও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশ সহ সকল প্রকার প্রাণিজ সম্পদ ও জীববৈচিত্রের ওপর একটি বড় ধরণের হুমকি এ দুর্গন্ধময়, দূষণ ও আর্বজনাযুক্ত পানি ।

প্রতিবেদক : আবদুল গনি, সহ-সম্পাদক চাঁদপুর টাইমস
: : আপডেট, বাংলাদেশ ৬: ০৩ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ মঙ্গলবার
ডিএইচ

Leave a Reply